ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার নিথর মরদেহ দেখার জন্য মানুষের ভিড় শুরু হয়েছিল গত ১২ সেপ্টেম্বর। ওয়েস্টমিনস্টার হলে রানির দেহ রাখার দুদিন আগেই জমতে শুরু করে মানুষের লাইন। আর ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষার সময় বেড়ে দাঁড়ায় আট ঘণ্টার ওপর। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর রানির শেষকৃত্যের আগপর্যন্ত এই লাইন থাকবে। টেমস নদীর তীরে মাইলের পর মাইল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ধৈর্যশীল প্রতিক্রিয়া সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। টুইটারে একজন তো এটিকে ‘ব্রিটিশদের এযাবৎকালের সেরা পারফরম্যান্স’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রশ্ন হলো, লাইনে দাঁড়ানো বা সারিবদ্ধ হওয়াই কি সেরা উপায়?
দুর্লভ সংস্থান বরাদ্দের জন্য আয়োজকদের বিশেষ উপায় প্রয়োজন হয়। এবারের ঘটনায় ওয়েস্টমিনস্টার হলে রাখা রানির কফিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার জায়গাটিই দুর্লভ। একটি আদর্শ ব্যবস্থায় যারা এটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিশ্চিত করবে, পাশাপাশি সবার জন্য সেখানে পৌঁছানোর সমান সুযোগও থাকবে। যারা প্রথমে আসে এবং যারা অপেক্ষা করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য কার্যকরভাবে জায়গা সুনির্দিষ্ট করে দেয় লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা। এর একটি বিকল্প হতে পারে লটারি, যেমনটি করা হয়েছিল গত জুনে রানির প্লাটিনাম জয়ন্তীর একটি কনসার্টে। অথবা কোনো ধরনের বাজার ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি স্লটের দাম এমন পর্যায়ে থাকবে যেন সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য আসে। উদাহরণস্বরূপ, বাকিংহাম প্যালেস দেখার জন্য ভ্রমণকারীকে অবশ্যই টিকিট কিনতে হয়।
রেশনিং প্রক্রিয়া হিসেবে লাইনে দাঁড়ানোর কিছু সুবিধা রয়েছে। এতে অপেক্ষার সময় কখনো কখনো সারারাত অথবা ন্যূনতম কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘ হতে পারে। ফলে দাঁড়ানো লোকদের আগ্রহ কতটা প্রবল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে লাইনের দৈর্ঘ্য থেকে। তাছাড়া যাদের টিকিট কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের সুযোগ হারানোর ঝুঁকিও কমায় এই ব্যবস্থা। তবে এর কিছু সমস্যাও রয়েছে। যদিও জায়গা পেতে অংশগ্রহণকারীদের অর্থ দিতে হচ্ছে না, কিন্তু তাদের সময় এবং স্বাচ্ছন্দ্য ব্যয় হচ্ছে ঠিকই। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের লাইন ব্যবস্থায় যাদের বিশেষ কোনো কাজ নেই তারাই বাড়তি সুবিধা পান। যেমন, যিনি কাজ এড়াতে পারছেন না, তাকে লাইনে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। আবার, দুর্বল কিংবা অসুস্থরা লাইনে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে সক্ষম না-ও হতে পারেন। বিকল্প ব্যবস্থাগুলো দীর্ঘ অপেক্ষার সমস্যা হয়তো কমাতে পারে, কিন্তু তাদেরও নিজস্ব কিছু অসুবিধা রয়েছে। লটারি ব্যবস্থায় অতিআগ্রহীরাও সুযোগবঞ্চিত হতে পারেন। হতে পারে কেউ রানিকে দেখতে খুব বেশি আগ্রহী, কিন্তু কেবল ভাগ্যের কারণে এতে খুব একটা পাত্তা দেন না এমন কারও কাছে জায়গা হারাবেন তিনি। আর বাজার-ভিত্তিক ব্যবস্থা অভিজ্ঞতা এবং কে সবচেয়ে বেশি অর্থ দিতে সক্ষম, তাকেই মূল্য দেবে। এটি অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর ও অন্যায্য মনে হতে পারে।
১৯৭৭ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির তৎকালীন অর্থনীতিবিদ মার্টিন ওয়েটজম্যান প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে চাহিদাগুলো আরও সমানভাবে বিতরণ করা হয়েছে অথবা যেখানে আয় অসমভাবে বিতরণ করা হয়েছে, সেখানে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার জন্য জিনিস বরাদ্দ করার সক্ষমতায় মূল্য নির্ধারণকে ছাড়িয়ে গেছে রেশনিং ব্যবস্থা (যার মধ্যে সারিবদ্ধতা অন্তর্ভুক্ত)। লাইন অনিয়ন্ত্রিত হলে, অর্থাৎ অপেক্ষমানরা স্থান অদলবদল করতে পারলে সেখানে বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে আসতে পারে। নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে শো’র টিকিট পেতে আপনার জায়গায় অন্য লোক ভাড়া করে লাইনে দাঁড়িয়ে রাখতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রথম দুই ঘণ্টা অপেক্ষার জন্য ৫০ মার্কিন ডলার এবং তারপরে প্রতি ঘণ্টায় অতিরিক্ত ২৫ ডলার খরচ করতে হবে আপনাকে।
লাইনে দাঁড়ানোয় অভ্যস্ত ব্রিটিশরা সম্ভবত এ ধরনের ব্যবস্থা মেনে নেবেন না। লন্ডনে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের স্থান চিহ্নিত করার জন্য হাতে রিস্টব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হয়। এটি লাইনের জায়গা অ-হস্তান্তরযোগ্য করে তোলে। এর ফলে ফাঁকি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেমন বন্ধ হয়, তেমনি অপেক্ষমান লোকেরা বাথরুমে যাওয়ারও সুযোগ পান।