কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী। তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। ব্যক্তিগতভাবে ধনাঢ্য ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক রুগ্নদশা কাটিয়ে ওঠতে কেমন ভূমিকা রাখতে পারেন, সেদিকে চোখ এখন কোটি ব্রিটিশের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংক ইংল্যান্ডের ঋণের দেনা কমিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি কতটা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেন তা জানতে কয়েক মাস অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও গতি নেই।
একের পর এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিদ্ধান্ত আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যয়ের মুখে ব্রিটেনের অর্থনীতি। করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে মৃত ইউরোপ–এমন অভিযোগ তুলে ইউরোপ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলেও সেই ইউরোপীয় নেতারাই ব্রিটিশ অর্থনীতির বিপর্যয় নিয়ে সরব। অনেক সমালোচক প্রশ্ন তুলছেন, তবে কি ইতালির মতো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে ব্রিটেনের?
ব্রিটেনে বসবাসরত বাম রাজনৈতিক সংগঠক নুরুর রহিম নোমান বলেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী সুনাক যদি আগের প্রধানমন্ত্রীদের পরিণতি থেকে শিক্ষা না নেন, তবে শুধু তার জন্য ব্রিটেনের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। ঋষি সুনাক এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী। তার স্ত্রী কোটি পাউন্ড কর প্রদান এড়াতে নন-ডমিসাইল স্ট্যাটাস ব্যবহার করছেন। ঋষি সুনাক কোভিড আইন অমান্য করে জরিমানা দিয়েছেন। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অসত্য কথা বলেছেন। ঋষি সুনাক নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা ২০ পাউণ্ড বহাল রাখেননি বিভিন্ন সংগঠন ও এমপিদের দাবি-অনুরোধের পরও। অভিবাসী পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি অভিবাসনবিরোধী। সাবেক দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল ও সুয়েলা ব্র্যাবারম্যানও অভিবাসনবিরোধী। কনজারভেটিভরা অনেক জলঘোলা করার পর সেই ঋষি সুনাককেই তাদের নেতা নির্বাচিত করেছে। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ক্ষীণ। দুঃখজনক হলেও লেবার নেতৃত্বও আশা জাগানিয়া নয়, লেবার নেতাও যেন ডানপন্থী কনজারভেটিভ পার্টিরই বর্ধিত শাখা।
উল্লেখ্য, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস কর কমানো এবং অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির জন্য সাহসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মাত্র সাত সপ্তাহ আগে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে দাঁড়িয়ে লিজ ট্রাস বলেছিলেন, আমরা সবাই মিলে ঝড়ের মোকাবিলা করব। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ‘মিনি বাজেট’ বাজারকে আশ্বস্ত করার বদলে অস্থিতিশীল করে তোলে। পাউন্ডের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় এবং সরকারের ঋণের খরচ বাড়ে। এরপর অস্থিতিশীল বাজার ঠিক করতে লিজ ট্রাস তার অঙ্গীকার থেকে পুরোপুরি সরে আসেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাকের নীতিই গ্রহণ করেন। এরপর জেরেমি হান্ট ট্রাসের প্রতিশ্রুতি থেকে পুরোপুরি সরে আসেন, যা ট্রাসের অযোগ্যতাকে আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এয়ারলাইন কোম্পানি রায়ানএয়ার-এর প্রধান মাইকেল ও’লেরি ব্রিটেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে একটি গাড়ি দুর্ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, লিজ ট্রাসের মিনি বাজেট ব্রেক্সিটের মূল ধারণাগত দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তিনি মনে করেন, যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন এবং যারা এর বাস্তবায়নে কাজ করেছেন, এটা তাদের ব্যর্থতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে সাবেক ব্রেক্সিটবিষয়ক সমঝোতার দায়িত্বে থাকা মিশেল বার্নিয়ারও একই মত পোষণ করেছেন। ১৯৯০ সালে মার্গারেট থ্যাচারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগেও ইউরোপে বিভাজন কনজারভেটিভ পার্টিকে জর্জরিত করেছিল।
বেলজিয়ামের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ইউরোপপন্থি গাই ভারহফস্ট্যাড বলেছেন, এই বিশৃঙ্খলা ২০২২ সালে শুরু হয়নি, হয়েছে ২০১৬ সালে। স্পেনের সমাজতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের মন্তব্যেও একই ইঙ্গিত ছিল। তিনি গত সপ্তাহে ব্রিটেনের সংকট উন্মোচিত হওয়ার পর ট্রাসের কর প্রস্তাবের নিন্দা করেছিলেন। স্পেনের পার্লামেন্টে তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাজ্যে চরম অস্থিরতা দেখছি।
কেউ কেউ যুক্তরাজ্যের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে বিশৃঙ্খল ইতালির মতোই মনে করছেন। এ বিষয়ে মুখ খোলেন ইউরোপের বাইরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। তিনি ব্রিটেনের ৪৫ শতাংশ শীর্ষ আয়কর হার বাতিল করার পরিকল্পনাকে ‘ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। এমন কী ব্রিটেনের কট্টর রক্ষণশীল সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ, যা ব্রেক্সিট গণভোটকে সমর্থন করেছিল, তারাও স্বীকার করেছে, অর্থনৈতিক লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে। ক্যামডেন লেবার পার্টির সদস্য সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম খছরু বলেন, ঋষি সুনাকের বড় চ্যালেঞ্জ হলো আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার দলকে ভুমিধস পরাজয় থেকে রক্ষা করা। জনমত জরিপেও লেবার পার্টি অনেক এগিয়ে।