২০১২ সালে সি চিন পিং যখন ক্ষমতায় এলেন তখন পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলেছিলেন, চীনের ইতিহাসে তিনিই কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে উদার নেতা হবেন। চিন পিংয়ের খুব সংক্ষিপ্ত জীবনকথা, পারিবারিক ইতিহাস এবং সম্ভবত কিছুটা ভ্রান্ত আশার ভিত্তিতে তারা ওই অনুমান করেছিলেন। ১০ বছর পর পর্যবেক্ষকদের ওই পূর্বাভাস ছেঁড়া কাগজের মতো বাতাসে উড়ে গেছে। এবারের চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ২০তম সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট চিন পিং নিজের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতে চলেছেন। এতে করে তিনি মাও সে তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক হতে যাচ্ছেন। এমন একজন নেতাকে বোঝা যে কতটা কঠিন, সেটা তাকে নিয়ে পর্যবেক্ষকদের পূর্বানুমানের ব্যর্থতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চিন পিং এতদিনে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণে তিনি কতটা নির্মম আর ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি কতটা অসহিষ্ণু হতে পারেন। তার আধিপত্য বিস্তারের লিপ্সা চীনের আধুনিক সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাপ ফেলেছে। একটা সময় ছিল, যখন তাকে জনসাধারণ একজন তারকা সংগীতশিল্পীর স্বামী হিসেবেই চিনত। সে অবস্থান থেকে নিজের কারিশমা আর রাজনৈতিক দক্ষতায় নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যা মাও সেতুংয়ের পর আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি।
চিন পিংয়ের প্রথম জীবনের রঙিন অধ্যায়ের অনেক কথা বাদ দিয়ে ও নতুন রূপে উত্থাপন করে সিপিসির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মূল মানুষটি যেন এখনো রহস্যময়ই রয়ে গেছেন। চিন পিংয়ের জীবনী নিয়ে একটি বইয়ের লেখক আলফ্রেড এল চ্যান এএফপিকে বলেন, শুধু ক্ষমতার স্বার্থে চিন পিং ক্ষমতা ধরে রাখতে লড়াই করেন, প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলন থাকলেও তার সঙ্গে আমি একমত নই। আমি মনে করি, চিন পিং নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী ধ্যানধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেন।
চীনা নেতার আরেক জীবনীকার অ্যাড্রিয়ান গেইজেস বলেন, চিনপিংয়ের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা রয়েছে বলে মনে হয় না। সম্পদের প্রতি চিন পিংয়ের মোহ নেই। তবে চীন সম্পর্কে তার সত্যিকারের একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আর সেটা হলো, তিনি চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে দেখতে চান। সেই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে রয়েছে চিন পিংয়ের ‘চীনা স্বপ্ন’ বা ‘চৈনিক জাতির মহান পুনরুজ্জীবন’। ‘সি: এ স্টাডি ইন পাওয়ার’ বইয়ের লেখক কেরি ব্রাউন লিখেছেন, চিন পিং একজন বিশ্বাসী মানুষ। তার জন্য কমিউনিস্ট পার্টিই হলো ঈশ্বর। চিন পিংয়ের বিশ্বাসকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়াটাই হলো তার সম্পর্কে বাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল।
সিপিসির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও চিন পিংকে একসময় একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে ধরা হতো না। চীনের বিপ্লবী নায়কদের একজন সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সি ঝং জুন ছিলেন চিন পিংয়ের বাবা। শৈশব থেকেই বাবার কঠোর অনুশাসনের অধীনে চিন পিং বেড়ে ওঠেন। তবে একটা সময় হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে। ঝং জুন তখন মাও সে তুংয়ের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। আলফ্রেড এল চ্যান বলেন, রাতারাতি যেন চিন পিংয়ের পরিবারের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। তাদের পারিবারিক মর্যাদা মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায়। অপমান সইতে না পেরে তার এক সৎবোন তো আত্মহত্যাই করে বসেন। স্কুলের সহপাঠীরা চিন পিংকে দূরে ঠেলে দেন।
রাজনৈতিক বিষয়াদির গবেষক ডেভিড শ্যামবাউগ বলেন, এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে অত্যন্ত অল্প বয়স থেকেই চিন পিংয়ের মধ্যে আবেগ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি এবং কর্তৃত্বপরায়ণতার বোধ তৈরি হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে চীনের গ্রামাঞ্চলে চিন পিংকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বছরের পর বছর গ্রামে ফসল সংগ্রহ করেছেন এবং গুহার ভেতরে ঘুমিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, গ্রামে শ্রমের তীব্রতা আমাকে হতবাক করেছিল। এমনকি তাকে ‘সংগ্রাম অধিবেশনেও’ অংশ নিতে হয় যেখানে তিনি তার বাবার নিন্দা করতে বাধ্য হন। ১৯৯২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় চিন পিং ফেলে আসা সেই সব অধিবেশন সম্পর্কে নিজের তিক্ত স্মৃতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যদি তুমি কিছু বুঝতে না পার, তোমাকে বুঝতে বাধ্য করা হবে। এতে অবশ্য তুমি কম বয়সেই জীবন সম্পর্কে পরিপক্ব হবে। জীবনীকার আলফ্রেড এল চ্যানও মনে করেন, অল্প বয়সের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে চিন পিংয়ের মধ্যে কঠোর মনোভাব গড়ে উঠেছে।
পারিবারিক কলঙ্কের কারণে চিন পিং শুরুর দিকে সিপিসির সদস্যপদ পেয়ে প্রবল বাধার মুখে পড়েন। তাকে সবাই অবমূল্যায়ন করত। তার সদস্যপদের আবেদন একাধিকবার বাতিল করে দেয়া হয়। অনেকবার চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত তার আবেদন গৃহীত হয়। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি শুরু করেন চিন পিং। তিনি ১৯৭৪ সালে একটি গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। সেখানে থেকে রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি উপকূলীয় ফুজান প্রদেশের গর্ভনর হন। ২০০২ সালে ঝেজিয়াং প্রদেশের এবং ২০০৭ সালে সাংহাইয়ের নেতা হন।
প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৯৮৭ সালে তারকা সংগীতশিল্পী পেং লিয়ুয়ানকে বিয়ে করেন চিনপিং। তখন লিয়ুয়ান অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন। জীবনীকার অ্যাড্রিয়ান গেইজেস বলেন, রাজনৈতিক যাত্রায় চিন পিং খুবই নিয়মতান্ত্রিক পথে চলেছেন। একেবারে তৃণমূলের গ্রামের নেতা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে উচ্চশিখরে নিয়ে গেছেন। ২০০৭ সালে তিনি পলিট ব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির (স্থায়ী কমিটি) সদস্য হন। এটি কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ। এর পাঁচ বছর পরই তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চিন পিং এখন অন্যতম ক্ষমতাধর বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছেন।