যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার মাড়ুয়া গ্রামের বর্গাচাষি রকিবুল ইসলাম। একবিঘা জমিতে চাষ করেছে ধুন্দল (স্থানীয় ভাষায় মিষ্টি পোল্লা)। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার স্থানীয় বারোবাজার ও চৌগাছা হাটে ৪০ কেজি ধুন্দল বিক্রি করেছেন মাত্র ৪০০ টাকা। বেপারীকে ডলতা (দাম ছাড়া ফাউ) দেয়া লেগেছে আরো ৫ কেজি। অর্থাৎ প্রতি কেজি দাম পড়েছে ১০ টাকারও কম। অথচ এই ধুন্ধল ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। সেখানে দেখা গেছে, পরিবহন ও চাঁদার টাকা পরিশোধের পর ঢাকায় পৌঁছাতে এক কেজি সবজিতে খরচ হয় মাত্র ৫ টাকা। যদিও বেপারীদের দাবি, তাদের খরচ পড়ে ১০ থেকে ১২ টাকা। এর মধ্যে জ্বালানিতেই যায় ১ টাকা ২০ পয়সা। এরপর ফড়িয়া, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতার হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছাতেই দাম বেড়ে হয়ে যায় ৮০ টাকা।
শুধু ধুন্দল নয়- ঢাকার বাজারে জনপ্রিয় সবজি পটোল, বেগুন ও কাঁচকলা কেনাবেচার ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় বাজার থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে প্রতিটি সবজির দাম বেড়ে যায় ৪ গুণ। যা কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বাজারে প্রতিনিয়তই ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। খাবারের তালিকায় সবজি রাখাটাই যেন এখন বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারের ওপর কঠোর নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোশিয়েসন অব বাংলাদেশ (ক্রাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মধ্যস্বত্ত ভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে সবজির প্রকৃত দাম থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফল ভোগ করা লাগছে ক্রেতাদের। লাভবান হচ্ছে ফড়িয়া, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতারা। তিনি বলেন, এ সমস্য থেকে উত্তরণের জন্য বাজার নজরদারি আরো কঠোর করতে হবে। একই সঙ্গে পথের চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে পবে। তাহলে ক্রেতারা একটু স্বস্তি পাবে।
জানা গেছে, যশোর ও ঝিনাইদহে দুটি বড় হাট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বারিনগর ও বারোবাজার। শনি ও মঙ্গলবার বারোবাজারে হাট বসে এবং রবি ও বুধবার বারিনগরে বাজার বসে। এই দুই হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা আসেন। স্থানীয় অন্তত শতাধিক গ্রামের কৃষকরা এ দুটি বাজারে সবজি বিক্রি করে থাকেন। এ দুটি বাজার ছাড়াও আরো কয়েকটি বাজার রয়েছে। কিন্তু দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা এ দুটি বাজারকে বেশি পছন্দ করেন। এ কারণে বাজার দুটিতে পাইকারদের আনাগোনা বেশি হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতি হাটেই বাজার দুটি থেকে অন্তত অর্ধশত ট্রাক সবজি বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে বেশি সবজি আসে ঢাকার কারওয়ান বাজার ও মিরপুরে। স্থানীয় ট্রাক ড্রাইভার মো. মিন্টু বলেন, ৫ টনের একটি ট্রাক ভাড়া নেয়া হয় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। ফেরি ভাড়া ২১শসহ লাইন খরচ (বিভিন্নস্থানে চাঁদা) দিয়ে ব্যয় হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তেল খরচ হয় ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। একটি ৫ টনের ট্রাকে ৫৪০০ কেজি সবজির ধারণক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এসব ট্রাকে কোন কোন সময় ১০ টনেরও বেশি সবজি পরিবহন করা হয়। সে হিসাবে ১০ হাজার ৮০০ কেজি সবজি বহনে প্রতি কেজিতে ব্যায় হয় ১ টাকা ৮০ পয়সা।
জানা গেছে, স্থানীয় বারোবাজারে প্রতিমণ (পাইকারি) পটোল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে সাড়ে ৮৫০, ধুন্দল ৪০০, বেগুন (কালো গোল) ১৬০০, কাঁচকলা ১২০০ টাকা। মণপ্রতি ক্রেতার খাজনা দেয়া লাগে ৮ থেকে ১০ টাকা। অথচ ঢাকার বাজারে এ ধরনের সবজি স্থান ভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে মাঝারি গোল কালো বেগুনের দাম কোথাও ১০০ টাকাও ছাড়িয়েছে বলে অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে। এর পেছনের কারণ হিসাবে সবজি পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ডিজেলের দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়তি খরচের চেয়ে আরও অনেক বেশি ট্রাক ভাড়া আদায় করছে। ফলে সবমিলিয়ে সবজিসহ সব ধরনের কাঁচামালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কোনো সবজি শহরকেন্দ্রিক ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়। হাতবদল, যান ব্যবহার ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাব, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যানজটসহ নানাবিধ কারণে বাজারে সবজির দাম বৃদ্ধি পায়। পাইকারি ক্রয়মূল্যের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি লাভ করার প্রবণতা খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে।
সূত্রমতে, দেশের উত্তরবঙ্গ থেকে দেশের সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা হলেও সেখানে তেমন বড় কোনো পাইকারি বাজার নেই। যার কারণে রংপুর, নাটোর, বগুড়া ইত্যাদি জেলা থেকে সবজি গাড়িতে করে বড় পাইকারি বাজার কুমিল্লার নিমসার আড়তে আসে। এখান থেকে আবার হাত বদল হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা শহরে এসব সবজি নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে আরেকদফা অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় ও হাত বদলের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাওরান বাজার থেকে পুনরায় পণ্য পাইকারি বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নেন, তাদের পণ্যবাহী বাহনেও বিভিন্ন রকমের খরচ করতে হয়। প্রথমেই তাদের পিকআপকে ২/৩ হাজার টাকার বিনিময়ে কাওরান বাজার স্ট্যান্ডে বাৎসরিক ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত হতে হয়। এছাড়া প্রতি ট্রিপে শতকরা ১০ টাকা হারে স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকারীদের দিতে হচ্ছে। কাওরান বাজারে চারশ’ বর্গফুট জায়গা প্রতিরাতের জন্য ভাড়া ২ হাজার ১শ’ টাকা এবং একই জায়গায় প্রতিদিনের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। যা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।
সূত্রমতে, বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাককে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে বগুড়া পৌরসভার ৫০ টাকা টোল দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। এরপর শেরপুর ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতিতে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ শহরে গাড়ি ঢুকলে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০ টাকা, যমুনা সেতু গোল চত্ত্বর হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০’ টাকা, টাঙ্গাইল মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০’ টাকা, আমিনবাজার, সাভার (লাঠিয়াল বাহিনী) প্রতি ট্রিপ এক থেকে ২০০’ টাকা, কাওরান বাজার পার্কিংয়ে ৫০০’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া প্রতি ট্রিপে যুমনা সেতুর টোল ১৪০০ টাকা রয়েছে।
এর বাইরে বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে ঢাকায় আসায় প্রতিটি ৫ টনের ট্রাকের প্রতি ট্রিপে ডিজেলে সাড়ে ছয় হাজার টাকা, চালক-হেলপারের বেতন দুই হাজার টাকা এবং রোড খরচ দুই হাজার টাকা খরচ হয়। যদিও ৫ টনের ট্রাকে সাধারণত ১০ থেকে ১২ টন সবজি পরিবহন করা হচ্ছে। ট্রাক চালকদের দেওয়া তথ্যমতে, একটি ৫ টন ট্রাক এক লিটার ডিজেলে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার যায়। ৩ টন মিনি ট্রাক এক লিটারে যায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার। এক থেকে দুই টন পিকআপ এক লিটারে যায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার। এ হিসেবে মহাস্থানহাট থেকে ২০২ কিলোমিটার দূরত্বে ঢাকা যেতে গড়ে ডিজেল লাগে ৫ টন ট্রাকের ৮০ থেকে ৮১ লিটার। সম্প্রতি ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকায় সমন্বয় করায় বর্তমানে ডিজেল বাবদ খরচ হয় ৬ হাজার ৪৬৪ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আগে খরচ হতো ৫ হাজার ২৫২ টাকা। এ হিসেবে বর্তমানে ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ১ হাজার ২১২ টাকা। যেহেতু অন্যান্য খরচ আগের মতই রয়েছে, সেহেতু ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ৫ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ ট্রিপপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। যার কারণে কাঁচামালের বাজার বেসামাল হয়ে উঠেছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন।