বাদলা দিনে
মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে
টাপুর টুপুর নদে এলো বান
ছেলেবেলাটা
মধুর ছিল, এ স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনগুলো। আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের গা
হিম করা গর্জন, টুপটাপ বৃষ্টির পতন, সে বৃষ্টি মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া, এ অনুভূতিগুলো মায়ের
মাড় দেওয়া শাড়িগুলোর মতোই যত্ন করে স্মৃতির আলমিরাতে তোলা আছে। মাঝেসাঝে কপাট খুলে
একটু উঁকি দিলেই মন ভালো হয়ে যায়। আহা সেই বৃষ্টি! আহা সেই শব্দ!
একটা কথা বলতেই
হবে, আমাদের শৈশবে প্রকৃতির সাথে একটা কেমন যেন সম্পর্ক ছিল। আমরা ফুলের সাথে খেলতাম,
গাছের সাথে কথা বলতাম, গাছ থেকে টুপ করে যে পাতাটা মাটিতে পড়তো তাকে মায়া করতাম। হয়তো
ধরেই নিয়েছিলাম প্রকৃতি আমাদের শোনে।
বড়ো হওয়া অনেককে
আজকাল একটু আধটু আফসোসের পাতাটা উল্টাতে দেখা যায়। কেউ আবার আফসোসের ধারেকাছ দিয়েও
যান না, তবে ফাঁক পেলেই দৌঁড়ে যান প্রকৃতির কাছে। একা একা উপভোগ করেন প্রকৃতির নিবিড়
ভাষা।
বিশ্বের যে
প্রান্তেই আপনার অবস্থান হোক না কেন, কিছু না কিছু শব্দ রোজ আপনার কানে আসে যা প্রকৃতির
সাথে সম্পর্কিত। ব্যস্ততার যাতাকলে অনেকেই সে-সব শব্দে কান কিংবা মন কোনটাই হয়তো দিতে
পারেন না। কিন্তু দিনের কোন না কোন সময়ে মন একটু টানেই। বিশেষ করে এখনের এই বৃষ্টির
মরসুমে।
ওদিকে একদল
মানুষ আছেন যারা কেবল প্রকৃতির নানান শব্দ খুঁজে বেড়ান। এমনও হয়, হয়তো মাটিতেই শুয়ে
থেকে কাটিয়ে দিচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি মাটি থেকেও কোন শব্দ আসে; মন্দ নয় তো! আবার
এমনও হয়, প্রকৃতির শব্দ খুঁজতে পাড়ি জমিয়েছেন গভীর পানির নিচে। যেখানটায় হয়তো আয়েশ
করে ঘুরে বেড়ায় হাঙরেরা।
শব্দের মাধ্যমে
মানুষ আর পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক শেখার বিষয়টিকে বলা হয় অ্যাকোস্টিক ইকোলজি। আর যারা
এই সম্পর্ক খুঁজতে শব্দের সন্ধান করেন, তাদের বলা হয় অ্যাকোস্টিক ইকোলজিস্ট। তাদের
এ কাজের নাম ফিল্ড রেকর্ডিং। যারা কী না প্রকৃতির শব্দ শোনার বিষয়টিকে নিয়ে গেছেন অন্য
মাত্রায়। নানান ধরণের শব্দ শোনার জন্য তারা কিন্তু আসলেই সময় নেয় এবং প্রতিটা শব্দের
আলাদা একটা অর্থবোধক মানে দাঁড় করায়। আর এই নানান ধরণের শব্দের খোঁজে তারা ছুটে বেড়ান
বিভিন্ন ধরণের পরিবেশে। এই পরিবেশের ব্যাপ্তি আসমান থেকে জমিন এবং পানির তল পর্যন্ত।
নানান ধরণের
শব্দে ডুবে আছি আমরা। মেট্রোরেইলের শব্দ, ফ্লাইওভার কিংবা নতুন রাস্তা হওয়ার শব্দ,
ট্রাফিক জ্যাম, গাড়ির হর্ন, শিশুর কান্না, মায়ের বকুনি, স্কুলে বাচ্চাদের চেচিয়ে পড়া,
কি-বোর্ডে টাইপ করা, সবটাই শব্দ। কিছু শব্দ বিরক্তির, কিছু শব্দ প্রশান্তির। কেমন হয়
যদি এই শব্দের মাধ্যমে চারপাশের জগতকে বোঝার একটুখানি চেষ্টা করা হয়?
কিছু সময়ের
জন্য সময়কে নিজের মতো চলতে দিন। আপনি থেমে যান। মোবাইল, কর্পোরেট জীবনের একঘেয়েমিকে
রাস্তায় ফেলে একটু আলাদা হন। কিছুক্ষণের জন্য একটু নির্জনে যান। দীর্ঘ পথে একা হাঁটার
অনুভূতি কিন্তু অনবদ্য। কোলাহল নয়, কিছু পুরোনো শব্দ নতুন করে শোনার সৌভাগ্য ভেবে নিন।
চোখ বন্ধ করুন আর কান পাতুন। কোন কথা না বলে কিছু শোনার চেষ্টা করুন। ঝরে যাওয়া পাতার
শব্দ, পাখির ডাক, পাতার ঘর্ষণ, বাতাসের শব্দ, একটা কাঠবিড়ালি দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। বৃষ্টির
শব্দ। শুনুন। শোনার চেষ্টা করুন। প্রকৃতিকে শোনার জন্য এর চেয়ে ভালো দিন কিংবা রাত
আপনি পেতেও পারেন, না-ও পারেন। কিন্তু যে মূহুর্তেই আপনি প্রকৃতির খুব কাছে অবস্থান
করবেন, চেষ্টা করুন প্রকৃতির শব্দ শোনার। শুনতে পাচ্ছেন কিছু? প্রকৃতির এই শব্দের দুনিয়ায়
আপনাকে স্বাগত। মন ভরে আজ একটু এই ডাকে সাড়া দিন। অন্য সব শব্দকে আজ না হয় 'না' করে
দিন। একটু সময় নিয়ে আজ সে সব শব্দে কান পাতুন যে-সব শব্দ কখনই মন দিয়ে শোনা হয়নি। একে
অপরকে বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটিই যেখানে শোনা, সেখানে আমরা কানে ইয়ারফোন
গুজে ডুবে থাকি কৃত্রিম শব্দের ভাণ্ডারে।
বিশ্বের কোথাও
না কোথাও প্রতিনিয়তই কোন না কোন শব্দ হচ্ছে। মাঝরাতে হঠাৎ ভাঙা ঘুমটাও হয়তো এ কারণেই
কিছু একটার খোঁজ করে। এ খোঁজ একটা নির্দিষ্ট শব্দ শোনার। কোন চামচ পড়ে যাওয়া কিংবা
কাঁচের বাটি ভাঙার শব্দ নয়, আবার কোন ভূতের চিৎকারও নয়। একটু অন্যরকম কোন শব্দ। যে
শব্দ শুনে মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে আবার ঘুম নামাবে দু'চোখের পাতায়।
শোনা, শ্রবণ,
শব্দ- এ নিয়ে এত কথার কারণ আজ ১৮ই জুলাই। World Listening Day (ওয়ার্ল্ড লিসেনিং ডে)
অর্থাৎ বিশ্ব শ্রবণ দিবস। এই শ্রবণের উদ্দেশ্য কথা কিংবা শব্দ দূষণ নয়, এ শ্রবণের উদ্দেশ্য
প্রকৃতিকে শোনা। তাই দিনটিকে যদি বলি- আজ প্রকৃতিতে কান পাতার দিন, সেটাও ভুল হয় না।
বিশ্ব শ্রবণ
দিবসটি প্রথম পালিত হওয়া শুরু করেছিল ২০১০ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছরই পালিত হয়ে আসছে
দিনটি।
১৮ই জুলাই কেন
এই দিবস সে প্রসঙ্গে বলা যায়, কানাডিয়ান সুরকার এবং অ্যাকোস্টিক ইকোলজি আন্দোলনের
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আর. মারে শ্যাফারের জন্মদিন আজকের দিনটিতে।
আমরা শুনতে
চাই তবে তা শব্দ দূষণ না। তাই অবসান হওয়া দরকার শব্দ দূষণের। একই সাথে দরকার মানুষের
সাথে পরিবেশের সম্পর্কে সামঞ্জস্য। আমরা চাই, আমাদের কানে শব্দ আসুক, যে শব্দ প্রশান্তি
দেবে। কপাল কুঁচকে রাখার মতো বিরক্তিকর শব্দ তো রোজই শুনি।
যে মূহুর্তে
কোন প্রাণির শব্দ আর কানে আসবে না, কোন পাতার ঘর্ষণ বা প্রকৃতির শব্দ ধীরে ধীরে শ্রবণের
বাইরে চলে যাবে, সেদিন থেকেই হয়তো বিরাট কিছু হারানোর দলে নাম লিখাতে থাকবো আমরা।