চীন ও রাশিয়া
টানা প্রায় ৩৫ বছর বাংলাদেশের অস্ত্রের প্রধান সরবরাহকারী ছিল। গত এক যুগে এই ধারায়
পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের আর্থিক সংগতি বাড়তে থাকায় অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী দেশের
সংখ্যাও বাড়ছে। ইতালি, তুরস্ক, সুইডেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পর প্রতিবেশী
ভারতও চায় অস্ত্রের জোগান দিতে। কারও কারও কাছ থেকে কিছু কিছু কেনাও হচ্ছে। আবার কারও
কারও প্রস্তাব আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে। এই তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে জাপান।
পূর্ব এশিয়ার
প্রভাবশালী ধনী দেশ জাপান নিজের প্রতিরক্ষানীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পর এবার কৌশলগত
অস্ত্রের উৎপাদনকারী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তারা অস্ত্রের বাজারও খুঁজতে শুরু করেছে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি।
আগামী নভেম্বরের
শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের কথা রয়েছে। ৩০ নভেম্বর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী
ফুমিও কিসিদার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা আছে বলে উভয় পক্ষের কয়েকজন কূটনীতিক জানিয়েছেন।
৫০ বছর ধরে অন্যতম প্রধান উন্নয়ন-সহযোগী দেশ হিসেবে জাপানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের যেকোনো
আলোচনায় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক
ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দিকগুলোই কেবল প্রাধান্য পেত। এবার এই ধারায় জাপানি প্রযুক্তির
অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব নতুন সংযোজন হতে যাচ্ছে বলে কূটনীতিকেরা জানান। জাপানের ‘উচ্চ প্রযুক্তির’ অস্ত্রের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষের বেশ আগ্রহ আছে বলে জানান তাঁরা।
তবে ভারত ও
প্রশান্ত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দেশের আরেক প্রধান উন্নয়ন-সহযোগী
চীনের সঙ্গে জাপানের তীব্র প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে অস্ত্র বিক্রির নতুন এই প্রস্তাবে
বাংলাদেশ কীভাবে সাড়া দেবে, তার ওপর চীনও নজর রাখছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে
নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান গতকাল শুক্রবার বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের ভেতরে নিরাপত্তা
সম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই স্বাভাবিক। আর জাপান বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন-সহযোগী। হয়তো সে কারণে
তারা এ বিষয়ে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে। তিনি বলেন, জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির
(আইপিএস) একটি উদ্যোক্তা রাষ্ট্র। কোয়াডে [যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের
জোট] দেশটির বিশাল ভূমিকা আছে। বিগ-বি উদ্যোগ [বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট]
নতুন করে এগিয়ে নিতে চায়। আইপিএস বিষয়ে বঙ্গোপসাগর এলাকায় জাপান বেশ তৎপর।
‘সামরিক জোটভুক্ত কোনো সম্পর্কে’ বাংলাদেশের যাওয়া সমীচীন হবে না উল্লেখ করে মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।’
জাপান ২০২০
সালের শেষ দিক থেকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক বিবেচনায়
রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। এর অংশ
হিসেবে ঢাকায় দেশটির দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উইং খোলা এবং একজন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগের
জন্য বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চাওয়া হয়।
প্রতিরক্ষা
খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে একজন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগের ‘সুযোগ আছে’ বলে ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত
ইতো নাওকি ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছিলেন।
সরকার ঢাকায়
জাপান দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উইং খোলা এবং প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে ইতিমধ্যে
সম্মতি দিয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে সে
দেশের নৌবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
আর সরকার জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে টোকিওতে
বাংলাদেশ দূতাবাসেও প্রতিরক্ষা উইং খোলার সুযোগ আছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
জাপান ও প্রভাবশালী
প্রতিবেশী ভারতের আপত্তির মুখে চীন কক্সবাজারের সোনাদিয়া ও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর
নির্মাণের সুযোগ হারানোর পর থেকেই দেশটির [চীন] সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন
আছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন জাপান সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে
মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন।