বাংলাদেশের শ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ে উদ্বেগ
জানিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় কমিশন। অর্থনীতিবিদরা এই প্রতিবেদনকে
‘সতর্ক বার্তা’ হিসেবে উল্লেখ
করে বলছেন, ইউরোপীয় কমিশনের উদ্বেগের বিষয়গুলো বাংলাদেশের গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
শনিবার (২ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে
বিবিসি বাংলা উল্লেখ করা হয়, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ বর্তমানে ইবিএ (এভরিথিং বাট আর্মস)
সুবিধা পায়। এর অর্থ হচ্ছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া রপ্তানিযোগ্য সব পণ্যের ইউরোপের
বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত প্রবেশাধিকার।
এই সুবিধার আওতায় বর্তমানে ৪৭টি দেশ রয়েছে।
এই দেশগুলোকে ইউরোপে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির
ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটার মানে এটা
নয়, তারা ইবিএ থেকে উইথ-ড্র করবে সেইটা না, তাদের কিছু কনসার্ন আছে। সুতরাং সেদিক থেকে
অবশ্যই এটা আমাদের সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত।’
গত ২১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিশন জিএসপি নিয়ে
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের সাথে হাই রিপ্রেজেনটেটিভ অব দ্য ইউনিয়ন
ফর ফরেইন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির সাথে যৌথভাবে করা একটি স্টাফ ওয়ার্কিং
ডকুমেন্টসও রয়েছে।
জিএসপি প্লাসভুক্ত ৯টি দেশের মধ্যে প্রত্যেকটির
জন্য এবং ইবিএভুক্ত শুধু তিনটি দেশের জন্য একটি ডকুমেন্টস তৈরি করা হয়েছে।
ইবিএভুক্ত এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ,
মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি এই তিনটি দেশের সাথে তাদের ‘কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে’ বলে প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়।
এসব দেশের সাথে যেসব ক্ষেত্রে ‘কর্মকাণ্ড বাড়ানো’ হয়েছে তার মধ্যে
এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে যা জাতিসংঘের মূল নীতি ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার
প্রতিবেদন ও পরামর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এতে ইবিএভুক্ত দেশগুলোতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট
ও কাউন্সিল, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, সুশীল সমাজ ও ট্রেড ইউনিয়নের বিভিন্ন পরামর্শ
বাস্তবায়নের অবস্থা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বর্তমানে থাকা জিএসপি নিয়মকানুনের মেয়াদ
চলতি বছরের শেষ দিকে শেষ হয়ে যাবে। নতুন জিএসপি নিয়মকানুন গ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া চলমান
রয়েছে।
এই সময়ে বর্তমান নিয়মকানুনের মেয়াদ ২০২৭
সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের কাজ
করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং কাউন্সিল।
যা আছে প্রতিবেদনে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
ইউরোপে রপ্তানির ক্ষেত্রে ইবিএভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে
বেশি সুবিধাভোগী দেশ।
গত কয়েক দশকে এই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ
তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাকশিল্পনির্ভর।
২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ
থেকে ২২,৬৭২ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপে বাংলাদেশের
সব রপ্তানিই ইবিএ সুবিধার আওতায় হয়ে থাকে।
২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত কোভিড মহামারি
সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অন্য ইবিএভুক্ত দেশের তুলনায় ইতিবাচক ছিল।
২০১৮ ও ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা
থেকে বের হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে দেশটি এই তালিকা থেকে বের হয়ে
যাবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার মানে হচ্ছে
এর তিন বছর পর বাংলাদেশ ইবিএভুক্ত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে সাধারণ জিএসপি ভুক্ত দেশ
হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়মিত তাদের উদ্বেগের
বিষয়গুলো বাংলাদেশকে জানিয়েছে। এ পর্যন্ত দুটি পর্যবেক্ষণ মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে।
একটি ২০১৯ সালের অক্টোবরে এবং আরেকটি ২০২২ সালের মার্চে। এই সফরের সময় ইইউ এর প্রতিনিধিরা
আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা
দিয়েছে।
মানবাধিকার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগের
বিষয়ে সীমিত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কিছু ইস্যুতে
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
২০২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মানবাধিকার
পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাবনার বিষয়ে যৌথ মোশন গ্রহণ করেছে।
ভবিষ্যতের যা করতে হবে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে
বলা হয়, শ্রম অধিকারের উদ্বেগের বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা
অনুযায়ী, শ্রম অধিকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে। একই সাথে আইএলও এর
রোডম্যাপ অনুযায়ী অর্জিত অগ্রগতি সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে হবে।
মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম
ও নির্যাতন অভিযোগের তদন্ত করতে হবে। একই সাথে মানবাধিকার কাউন্সিলের সুপারিশ বাস্তবায়নে
উদ্যোগী হতে হবে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের
তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার আলোকে জিএসপিবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন
পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
এর ফলে বাংলাদেশ ইবিএ থেকে সাধারণ জিএসপি
সুবিধাভুক্ত হবে। তখন বাংলাদেশ যে জিএসপির সব ধরনের নিয়ম বিশেষ করে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো
পূর্ণ করতে সক্ষম তা দেখাতে পারে।
বাংলাদেশ তার জিএসপি সুবিধার শর্ত বাস্তবায়ন
করছে কিনা তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা অব্যাহত রাখবে ইইউ। একই সাথে ২০২৩ সালের নভেম্বরে
ঢাকায় ইইউ’র একটি উচ্চপর্যায়ের
মিশনের মাধ্যমে চলমান সম্পৃক্ততা আরও বাড়াবে।
সতর্কবার্তা? ২০১৭ সালে প্রথম এই দেশগুলোর
সঙ্গে ‘কর্মকাণ্ড বাড়ানো’ হয় এবং এটি এ-সংক্রান্ত
দ্বিতীয় নথি বলেও জানানো হয়। এই তিনটি দেশের বাইরে ইবিএভুক্ত ৪৭টি দেশের মধ্যে আর কোনো
দেশ নিয়ে এই নথি বানানো হয়নি।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই
প্রতিবেদনের মানে হচ্ছে তারা এই দেশগুলোকে বিশেষ পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘এটা থেকে এটাই
প্রমাণিত হচ্ছে যে তাদের কিছু কনসার্ন আছে। তারা কনসার্নগুলো এই তিনটা দেশের সাথে আলাপ-আলোচনা
করছে, তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে এবং এটা যে মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখছে, সেটাও তারা
জানাচ্ছে। সুতরাং সেদিক থেকে অবশ্যই এটা আমাদের সিরিয়াসলি নেয়া উচিত।’
তিনি বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা যাদের
দেওয়া হতো তারা সব ধরনের শর্ত মানছে কিনা সেটির প্রতিই নজর ছিল ইউরোপীয় কমিশনের। ইবিএ
বা সাধারণ জিএসপিভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে তারা খুব একটা সচেতন থাকতো না। বরং ইবিএ সুবিধাটাও
মোটামুটিভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দেওয়া হতো।
তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে, ইবিএভুক্ত দেশগুলোর
প্রতিও বিভিন্ন ইস্যুগুলো নিয়ে আরও বেশি সংশ্লিষ্ট হচ্ছে এবং এই ইস্যুগুলো মানা হচ্ছে
কিনা সেটা নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
তিনি মনে করেন, এই প্রতিবেদনকে বাংলাদেশের
গুরুত্বের সাথে নিয়ে সেগুলো নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ রপ্তানির ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের জন্য ইউরোপ একটা বড় বাজার। সেখানে বাংলাদেশ যে শূন্য শুল্ক সুবিধা পায়,
সেটা তৈরি পোশাক তো বটেই সব ধরনের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১২ শতাংশ শুল্ক
দিতে হয় না। সেটার দিক থেকে এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন,এটি একটি ‘সতর্কবার্তা’ কারণ ইবিএভুক্ত
যে ৪৭টি দেশ আছে তাদের মধ্যে মাত্র তিন দেশ নিয়ে এই আলোচনাটা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো
যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে, সেটার বিষয়ে তারাও কিছু কিছু বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়।
এর মধ্যে রয়েছে, শ্রম অধিকার, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার ইত্যাদি।
কিছুদিন আগে শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রও
তাদের নতুন নীতির ঘোষণা দিয়েছে এবং সেখানে বাংলাদেশের এক গার্মেন্টস কর্মী ও শ্রমিক
নেতা কল্পনা আক্তারকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা আসলে
সারা বিশ্বের শ্রম পরিস্থিতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি নীতি গ্রহণ করেছে যেখানে বাংলাদেশের
শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।