ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে শেষ বিদায় জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। দেশটির আধুনিককালের বিরলতম এবং নিখুঁত পরিকল্পনার এ শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন বিশ্বনেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। শেষযাত্রায় রানীর প্রতি দেখানো হয় অভূতপূর্ব ভালোবাসা। তাঁর কফিনের সামনে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়েছেন লাখো মানুষ। এ সময় চোখ ভিজেছে অগণিত গুণমুগ্ধের। দিনভর নানা অনুষ্ঠান শেষে রানীকে উইন্ডসর ক্যাসলের সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে তাঁর পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জ, মা রানী এলিজাবেথ এবং বোন রাজকুমারী মার্গারেটের পাশে সমাহিত করা হয়েছে। তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের কফিনও তাঁর পাশে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফিলিপ গত বছর ৯৯ বছর বয়সে মারা গেছেন।
এর আগে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে থেকে এক বিশাল শোকযাত্রা রানীর কফিন নিয়ে ওয়েলিংটন আর্চের দিকে যাত্রা করে, যেটি ব্রিটিশ ইতিহাসের এক গৌরবময় প্রতীক। রানীর কফিন এর পর একটি শবযানে রাখা হয়। এটি যাত্রা করে উইন্ডসরের দিকে। কফিন নিয়ে তৃতীয় শোক মিছিলটি উইন্ডসরের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে যায়। সেখানে রানীর স্মরণে প্রার্থনায় যোগ দেন প্রায় ৮০০ মানুষ। এ অনুষ্ঠানে যাঁরা যোগ দিচ্ছেন, বেশিরভাগই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের অনুষ্ঠানে ছিলেন না। রানীর অনেক বর্তমান এবং সাবেক স্টাফ এ প্রার্থনায় যোগ দেন। সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি টানা হয় সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে। পরে রাজকীয় সমাধিকক্ষে রানীর মরদেহ নামানো হয়। সন্ধ্যায় রাজপরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে রানীকে সমাহিত করা হয়। এর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে রানীর কফিনের ওপর থেকে রাজমুকুট এবং রাজদণ্ড সরিয়ে নেওয়া হয়। এগুলো আবার টাওয়ার অব লন্ডনে ফেরত যাবে।
রাজমুকুট ও রাজদণ্ড শোভিত এবং পতাকা আচ্ছাদিত রানীর কফিনটি দেখার জন্য লন্ডনে রাস্তায় জনতার ঢল নেমেছিল। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি অন্য দেশের নাগরিকরাও ছিলেন এই শোকের মিছিলে। এর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে পাইপ এবং ড্রামের সুরে একটি কামানবাহী গাড়িতে তাঁর মরদেহ রাজকীয় নৌবাহিনীর ১৪২ জন সদস্য ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নিয়ে যান। রানীর শেষযাত্রা সরাসরি দেখতে লন্ডনের রাস্তার পাশে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষ শোক আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে তাঁকে বিদায় জানিয়েছে। রাত থেকেই রাস্তার পাশে তাঁবু টানিয়ে মানুষজন অপেক্ষায় ছিল রানীর শেষযাত্রা দেখার জন্য। কেউ এনেছিল স্লিপিং ব্যাগ আবার কেউ ফোলানো বিছানা। এমনকি ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়েও এসেছিল কেউ কেউ।
গত ৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের বালমোরালে নিজের গ্রীষ্ফ্মকালীন প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান রানী এলিজাবেথ। ৭০ বছর ধরে তিনি ব্রিটিশ সিংহাসন আলোকিত করেছেন। তাঁর সম্মানে ১০ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের গির্জায় প্রার্থনা অনুষ্ঠানের পর ৪৫ মিনিটের যাত্রা শেষে ওয়েলিংটন আর্চে পৌঁছে রানীর শবমিছিল। এ সময় গির্জায় উপস্থিত দুই হাজার মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে রানীকে সম্মান জানান। ওয়েস্টমিনস্টারের ডিন ডেভিড হোয়েলের নেতৃত্বে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে। গির্জায় রানীর আত্মার শান্তি কামনা করে কমনওয়েলথের মহাপরিচালক ব্যারোনেস স্কটল্যান্ড প্রথমে বাইবেলের একটি অংশ পাঠ করেন। এর পর বিশেষভাবে রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য জুডিথ ওয়্যারের লেখা একটি গান বাজানো হয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস দ্বিতীয়জন হিসেবে বাইবেলের একটি অংশ পাঠ করে রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তার পর ক্যান্টাবুরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি ধর্মোপদেশ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় আর্চবিশপ বলেন, ৭০ বছরের শাসনামলে রানী 'বহু মানুষের জীবন ছুঁয়ে গেছেন'। গির্জার অন্য নেতারাও একে একে প্রার্থনা করেন। ১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানে যে গানটি গাওয়া হয়েছিল; তাঁর শেষযাত্রায়ও সেই গানটি গাওয়া হয়। জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে গির্জায় প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় প্রার্থনা শেষে রানীর শবমিছিল উইন্ডসর ক্যাসলের দিকে রওনা হয়। এই পথে মিছিলটি প্রথমে পার্লামেন্ট স্কয়ার অতিক্রম করে। সে সময় যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি যৌথ দল রানীর কফিনে গার্ড অব অনার জানায়। সেখান থেকে শবমিছিল পার্লামেন্ট স্ট্রিট হয়ে ওয়েলিংটন আর্চের পথে চলতে শুরু করে। শবমিছিল অতিক্রম করার সময় লন্ডনের সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কগুলোর একটি পার্লামেন্ট স্ট্রিটে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সেখানে উপস্থিত লোকজন দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে প্রিয় রানীকে সম্মান জানায়। মিছিলটি লন্ডনের বিখ্যাত 'বিগ বেন'-এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রানীর সম্মানে ৬০ সেকেন্ডের জন্য ঘড়ির কাঁটা স্তব্ধ করে রাখা হয়। ওয়েলিংটন আর্চে পৌঁছানোর আগে শেষবারের মতো লন্ডনের রাজকীয় দুটি পার্ক অতিক্রম করে রানীর মরদেহ। শবমিছিলটি প্রথমে গ্রিন পার্ক (রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬৮ সালে এই পার্কটি উদ্বোধন করেন), তারপর সেন্ট জেমস পার্ক (সবচেয়ে পুরোনো রাজকীয় পার্ক) অতিক্রম করে। সেখান থেকে শবমিছিলটি বাকিংহাম প্যালেস অতিক্রম করে ওয়েলিংটন আর্চে পৌঁছে।
এর আগে স্থানীয় সময় সকালে ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানীর কফিন নিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। এ সময় রানীর বড় ছেলে রাজা তৃতীয় চার্লস, তাঁর বোন প্রিন্সেস অ্যান, দুই ভাই প্রিন্স অ্যান্ড্রু, প্রিন্স এডওয়ার্ডসহ ব্রিটিশ রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা রানীর কফিন অনুসরণ করেন। কফিনটি একটি গান ক্যারিজে বা কামানবাহী গাড়িতে করে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নেয় রাজকীয় নৌ সেনারা। এই ভবনে রানীর বিয়ে এবং সিংহাসনে অভিষেক হয়েছিল। অবশেষে সেখানেই শেষযাত্রায় প্রার্থনা অনুষ্ঠান হলো।
১৯৫২ সালে রাজা জর্জের শেষকৃত্যের পর এবারই বড় ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে রানীর শেষকৃত্য হয়। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য গত বুধবার থেকে রানীর কফিন ওয়েস্টমিনস্টার হলে রাখা হয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজপরিবারের সদস্যসহ প্রায় পাঁচশ বিশ্বনেতা এবং কূটনীতিক রানীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য রানীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। বেসামরিক নানা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের সদস্যরাও রানীর শবমিছিলে অংশ নিয়েছেন। টেলিভিশনে যুক্তরাজ্যসহ গোটা বিশ্বের মানুষ এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দেখছেন। যুক্তরাজ্যজুড়ে কয়েকটি বড় পর্দায় সরাসরি রানীর শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা দেখানো হয়। রানীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যুক্তরাজ্যে কয়েকটি সিনেমা হল বন্ধ রাখা হলেও ১২৫টি খোলা রাখা হয় শেষকৃত্য প্রচারের জন্য।