চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত
বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করতে আগামী ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। উদ্বোধনের পরেই টানেলের ভেতরে যান চলাচল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
বঙ্গবন্ধু টানেল ছাড়াও এদিন প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের আরো ১৯টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন
করবেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক মহাসমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো.
ফখরুজ্জামান বলেন, আগামী ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু
টানেলসহ মোট ২০টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম
জেলা প্রশাসনের সাতটি প্রকল্প রয়েছে। অনেকগুলোর কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো
আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন, প্রধানমন্ত্রীর
সমাবেশে ১০ লাখ লোকসমাগমের প্রস্তুতি :
উদ্বোধনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু
টানেল। শনিবার এটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর তিনি চট্টগ্রামের
আনোয়ারায় এক জনসমাবেশে যোগ দেবেন। তার এ সফরকে ঘিরে বন্দরনগরীতে উৎসবের আমেজ বিরাজ
করছে। এ জনসভায় ১০ লাখ লোকসমাগমের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী
লীগ সূত্রে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে টানেলের পতেঙ্গা
ও আনোয়ারা প্রান্তে চলছে সাজানোর প্রস্তুতি। সমতল করা হচ্ছে জনসভার স্থান আনোয়ারার
কেইপিজেডের মাঠ। সংস্কারের পাশাপাশি রং করা হচ্ছে সড়কগুলো। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত
জানাতে নগরী ও আনোয়ারা প্রান্তে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পোস্টার আর
ব্যানারে ছেয়ে গেছে পথঘাট।
টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরের সামনে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ম্যুরাল। সঙ্গে চট্টগ্রামের
ঐতিহ্যবাহী সাম্পান। জনসভার স্থানে চলছে মঞ্চ তৈরির কাজ। পরিদর্শন করছেন আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীরা।
স্থানীয়রা জানান, ১০ হাজার কোটি টাকায়
তৈরি ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ টানেল ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমাবে ৫০
কিলোমিটার। এতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিল্পখাতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরের প্রথম
পর্বে পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল উদ্বোধন করবেন। এরপর টানেলের ভিতর দিয়ে তিনি আনোয়ারা
প্রান্তে যাবেন। তারপর আনোয়ারায় কেইপিজেডের মাঠে রাজনৈতিক জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
সেখানে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করবেন তিনি। এজন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনী ও র্যাবের ডগ স্কোয়াড দিয়ে চালানো হচ্ছে তল্লাশি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ
সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, দেশের প্রথম টানেল উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে আসছেন। আমাদের টার্গেট প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশে ১০ লাখ মানুষের
সমাগম ঘটানো। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে আনন্দ। আশা
করি, এটাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় জনসভা।
পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ নিজ কার্যালয়ে
সাংবাদিকদের জানান, কর্ণফুলী টানেলের সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু প্রধানমন্ত্রীর
টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সেতু বিভাগের লোকজন এবং প্রকল্পের
লোকজন মিলে উদ্বোধনী কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আগামী ২৮ অক্টোবর সকালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেভালে আসবেন। সেখান থেকে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের
উদ্বোধন করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী টানেল ক্রস করে আনোয়ারা প্রান্তে যাবেন। সেখানেও
উদ্বোধনী ফলক লাগানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করবো প্রধানমন্ত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারায় জনসভা করবেন। টানেলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সম্পৃক্ত
করতে পেরে এই জন্য গর্ববোধ করেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ।
তিনি বলেন, এই টানেলটি নির্মাণে প্রকৌশলীরা
দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এই টানেল সারাদেশের গর্বের প্রতীক। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের
অসাধারণ কর্মনৈপুণ্য ও স্থাপত্যশৈলী আমাদেরকে উপহার দিতে যাচ্ছে। এটা আমাদের বিশাল
সাফল্য, এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ টানেলটি তিন
থেকে সাড়ে ৩ মিনিট সময়ের মধ্যে পার হতে পারবে। টানেলটি শুধু দুই প্রান্তের সংযোগ করবে
না, টানেলটি ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্টে নিয়ে নির্মিত হয়েছে। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে
যুক্ত হবে এটি। কক্সবাজারের সঙ্গেও যোগাযোগ সহজ হবে।
ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাসে টানেলে কোনো নেতিবাচক
প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, দুটো ফ্লাডগেট আছে, গত সাইক্লোনে
ট্রায়াল করে দেখা হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে কোনো সমস্যা হবে না।
তাছাড়া টানেলটি নদীর পৃষ্ঠ থেকে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ভূমিকম্পের
প্রভাব পড়বে না। ভূমিকম্পে টানেল নিরাপদ থাকবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ মিটার থেকে
৩১ মিটার নিচ দিয়ে এ টানেল গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম আগমন ও বঙ্গবন্ধু
টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে ট্রাফিক নির্দেশনা :
বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম আগমন করবেন। এ উপলক্ষে বিশেষ ট্রাফিক নির্দেশনা
দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
বৃহস্পতিবার সকালে গণমাধ্যমে প্রেরিত সিএমপির
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে ভিভিআইপি/ডিআইপি চট্টগ্রাম
বিমানবন্দর এবং টানেল ও সি-বিচ এলাকায় সড়ক পথে চলাচল করবেন।
ভিভিআইপি/ডিআইপিদের নিরাপত্তা ও সড়ক পথে
নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২৮ অক্টোবর ভোর ৫টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না
দেওয়া পর্যন্ত যানবাহন ও সর্বসাধারণের চলাচলের ওপর নিম্নরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো।
ক) সিমেন্ট ক্রসিং-কাঠগড় হয়ে কোনো যানবাহন
সি-বিচ বা এয়ারপোর্ট গমন করতে পারবে না।
খ) এয়ারপোর্টগামী সব সম্মানিত জনসাধারণকে
সিমেন্ট ক্রসিং থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে বোটক্লাব হয়ে যাতায়াত করার জন্য অনুরোধ করা
হলো।
গ) বিমানবন্দর মোড় ক্রস করে বাটারফ্লাই
পার্ক হয়ে টানেল ও সি-বিচ এলাকায় গমন করা যাবে না।
ঘ) ফৌজদারহাট আউটার লিংক রোডে যান চলাচল
সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। সর্বসাধারণের সুবিধার্থে বন্দরগামী যানবাহন আউটার লিংক রোড পরিহার
করে ‘সিটি গেইট- একে
খান- সাগরিকা রোড ক্রসিং- বড়পুল- নিমতলা’ হয়ে চলাচল করবে।
ঙ) ২৭ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশনা
না দেওয়া পর্যন্ত কেউ সি-বিচ এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।
উল্লেখ্য, গত ১৩ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের
মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু টানেল পারাপারে সর্বনিম্ন টোল ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে
প্রাইভেটকার ও জিপের জন্য। সর্বোচ্চ টোল দিতে হবে ট্রাক ও ট্রেইলারকে। ট্রেইলারের
ক্ষেত্রে নির্ধারিত টোলের সঙ্গে প্রতিটি এক্সেলের জন্য আরও ২০০ টাকা করে বাড়তি দিতে
হবে।
এ ছাড়া পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০
টাকা, বাস (৩১ সিটের কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসনের বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩ এক্সেল) ৫০০
টাকা, ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫ দশমিক ০১ থেকে ৮ টন) ৫০০ টাকা, ট্রাক
(৮.০১ থেকে ১১ টন) ৬০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার (৩ এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার
(৪ এক্সেল) ১০০০ টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রাক ও ট্রেইলারগুলোকে ১০০০ টাকার সঙ্গে
প্রতি এক্সেলের জন্য আরো ২০০ টাকা করে টোল দিতে হবে।
জানা যায়, টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায়
১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীন সরকার ‘জি-টু-জি’ অর্থায়নে টানেলটি
নির্মাণ করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার
৯১৩ কোটি টাকা দিয়েছেন চীন সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের
টানেল নির্মাণকাজের যৌথভাবে ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও
চীনা রাষ্ট্রপতি শিং জিনপিং। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম
টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ টানেলটির নির্মাণ
প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।