হঠাৎই যেন ব্রিটেনের রাজনীতিতে আবার আলোচনার
ঝড়। নানা কেলেঙ্কারির কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার এক বছর পূর্তির আগেই
এমপির পদ থেকেও বিদায় নিলেন ‘ব্রিটেনের ট্রাম্প’ খ্যাত বরিস জনসন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রক্ষণশীলতার দিকে মিল থাকায়
বরিসকে এই নামে অনেকেই ডাকেন। তবে বরিসের দলটিই রক্ষণশীল দল (ইংরেজি নাম কনজারভেটিভ
পার্টি)। পদত্যাগের কারণে বরিস যেমন নিজের রাজনৈতিক জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন, তেমনি
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছেন।
কেন
হঠাৎ পদত্যাগ বরিসের
পার্টিগেট কেলেঙ্কারির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত
রিপোর্ট পেশ হওয়ার আগেই এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
এক হাজার শব্দে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেছেন। এর
আগে শুক্রবার সকালে প্রিভিলেজেস কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি হাতে পান জনসন।
বরিসের মতে, ঐ প্রতিবেদন হেয়ালি, অসত্য ও পক্ষপাতে পূর্ণ। এর পর সন্ধ্যায় দেওয়া এক
বিবৃতিতে বরিস দাবি করেন, কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এমন একটি প্রমাণও হাজির করতে সক্ষম
হয়নি যাতে প্রমাণ হয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে হাউজ অব কমনসকে (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ)
বিভ্রান্ত করেছেন।
আরও পড়ুন<< কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম নারী গভর্নর পেলো তুরস্ক
আজ সোমবার প্রতিবেদনটি পূর্ণাঙ্গ হতে পারে।
শিগিগরই এটি প্রকাশ করা হতে পারে। জানা গেছে, বরিস পার্টিগেট নিয়ে পার্লামেন্টকে মিথ্যা
তথ্য দিয়েছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। এজন্য শাস্তিস্বরূপ তাকে ১০ দিনের বেশি সময়
পার্লামেন্ট থেকে বরখাস্ত করা হতে পারে। ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারি চলাকালীন যুক্তরাজ্যের
প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিস জনসন। সে সময় করোনার বিধিনিষেধ না মেনে তার কার্যালয়ে একাধিক
পানাহারের আয়োজন করেন তিনি। এ ঘটনাকেই ‘পার্টিগেট’ কেলেঙ্কারি বলা
হয়। এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন
বরিস জনসন।
রাজনৈতিক
জীবন ঝুঁকির মুখে বরিসের
বরিস জনসনের হঠাত্ পদত্যাগে ষড়যন্ত্রের
গন্ধ দেখছেন ক্ষমতাশীন টোরি দলের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সমর্থক এমপিরা।
এমনকি একসময় বরিসের সহযোগীও তার পদত্যাগের সমালোচনা করেছেন। তার পদত্যাগের পর নিজ দলের
এমপিদের চাপের মুখে পড়েছেন ঋষি সুনাক। তারা অভিযোগ করেছেন, সরকারকে লাইনচ্যুত করতেই
বরিস এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রিভিলেজেস কমিটির সমালোচনা করে বরিস দেশের সুনাম
নষ্ট করেছেন। তারা চান যে, বরিস যেন আগামীতে দলের নেতৃত্বের লড়াইয়ে না নামতে পারেন।
তাকে নিষিদ্ধ করারও দাবি এসেছে বিরোধী এমপিদের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন<< পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের ঘোষণা বরিস জনসনের
এমনকি বরিসের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও
১৯২২ কমিটির সিনিয়র সদস্যও পার্লামেন্ট নির্বাচনে বরিসকে নিষিদ্ধ করতে বলেছেন। তিনি
বলেছেন, যে কোনোভাবেই বরিসকে থামাতে হবে। যত দ্রুত থামানো যাবে, ততটাই মঙ্গল হবে দলের
জন্য। বরিস পার্লামেন্টকে বিদ্রুপ করেছেন বলে অনেকের অভিযোগ। তিনি আবার এমপি হলে সরকারেরই
বদনাম করবেন। টোরি দলের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী মাইকেল হেসেলটিন বলেছেন, বরিসকে আর পার্টির
নেতৃত্বে আনা উচিত নয়।
ক্রিস ব্রায়ান্ট নামের এক এমপি বলেছেন,
বরিস পার্লামেন্টকে অবমাননা করেছেন। তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। এমনকি তাকে
পার্লামেন্টেও প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। গত মার্চে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ
ব্রিটিশ মনে করেন, পার্টিগেট কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হলে বরিসের পদত্যাগ করা উচিত।
বরিসের সঙ্গে কাজ করেছেন এমন অনেকে বলেছেন যে, আগামী পাঁচ বছরে বরিসের ফিরে আসার সম্ভাবনা
নেই।
বরিসের একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলেছেন, বরিস
নিজেকে পানির ওপরের প্রিন্স মনে করেন। তবে পার্লামেন্টে অবস্থান না থাকলে যে সত্যিকারের
প্রিন্স হওয়া যায় না, সেটা হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন না। আবার বরিসের জীবনের ইতিহাস বলে
যে, তার মধ্যে প্রচুর অহংবোধ রয়েছে। তিনি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বুঝতে চান না। তার মধ্যে
দাম্ভিকতাটা বেশি। বরিস মনে করেন, নিয়ম তার জন্য নয়, অন্য মানুষের জন্য। তার মধ্যে
নৈতিকতারও ঘাটতি আছে বলে তার সাবেক মিত্ররা মনে করেন।
নেতৃত্বের
চ্যালেঞ্জে সুনাকও
কেবল বরিসই পদত্যাগ করেননি, তার দুই মিত্র
নাইজেল অ্যাডামস এবং নাডিন ডোরিসও শনিবার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী
সুনাকের সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগেই তিনটি উপনির্বাচনের আয়োজন করতে
হবে। আরো দুই-একজন পদত্যাগ করতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এসব উপনির্বাচনে বিরোধী লেবার
পার্টি এবং লিব ডেমের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। টোরি দলের এমপিরাও তিনটি আসন হারানোর আশঙ্কা
করছেন।
যদিও সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ
৬৫০ আসনের হাউজ অব কমন্সে টোরি এমপি আছেন ৩৫৪ জন। প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে ৬৪টি বেশি।
তবে আতঙ্ক এই যে, ইতিমধ্যে ৪৪ জন টোরি এমপি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন
না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বিরোধী লেবার পার্টি আগামী নির্বাচনে
১৪৪টি আসনে এগিয়ে আছে।
আরও পড়ুন<< নতুন বিশ্বরেকর্ড ভাঙার তথ্য জানালেন ইমরান খান
টোরি এমপিদের আশঙ্কা, প্রধানমন্ত্রী ঋষি
সুনাক যখন দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, সেই মুহূর্তে বরিসের সরে যাওয়াটা
ভালো লক্ষণ নয়। একজন তো বলেছেন, বরিসরা চান না যে, ঋষি সুনাক সফল হোন। ইতিমধ্যে বিরোধী
লেবার পার্টি আগাম সাধারণ নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। দলের মধ্যে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে
তাতে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সরকার পরিচালনা ঋষি সুনাকের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে
পারে। আর আগামী নির্বাচনে জিতে আসাটা তো সুনাকের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের।