ঢাকা থেকে সুশান্ত সাহা
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও থেমে নেই স্বর্ণ চোরাচালান। প্রতি মাসেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণের চালান জব্দ করা হচ্ছে। কোনো কোনো চালানে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণও জব্দ করেছে কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। তারপরেও স্বর্ণের চালান আসছেই। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কোটি কোটি টাকার চালান আটকের পরেও পাচারকারীরা কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। এছাড়া স্বর্ণের বড় বড় চালান জব্দ হলেও চোরাচালানি চক্রের নেপথ্যের প্রভাবশালীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ফলে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া কিছু বহনকারী ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে আবারো স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত হচ্ছে। আবার মামলার দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ, সাক্ষীর অভাব, তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্বলতাসহ নানা কারণে অপরাধীদের শাস্তিও হচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন সময় বিমানের টয়লেটে স্বর্ণ, বিমানের সিটের নিচে স্বর্ণের প্যাকেট, যাত্রীর জুতার ভেতরে স্বর্ণ, লাগেজে স্বর্ণ আবার কখনো বা যাত্রীর পেটের ভেতরে ও পায়ুপথেও পাওয়া যায় স্বর্ণ।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২ দফায় মোট ১০৭টি সোনার বার ও ৫০০ গ্রাম সোনার অলংকার জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এর মধ্যে ওই দিন বিকালে চীন থেকে আসা গার্মেন্টস এক্সেসরিজের কার্টন তল্লাশি করে ৯৬টি সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। আটক করা সোনার বারের ওজন প্রায় ১১ কেজি। এগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। এদিন দুপুরে ঢাকার আল ফয়েজ জুয়েলার্সের হিসাবরক্ষক নুরুন্নবীকে ১১টি সোনার বার ও ৫০০ গ্রামের স্বর্ণালংকারসহ আটক করে এপিবিএন।
এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক জানান, নুরুন্নবী বিমানযাত্রী ছিলেন না। তিনি বিমানবন্দরে স্বর্ণ সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। গত ২৫ ফেব্রæয়ারি শাহজালালে মো. সুরুজ্জামান নামে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে চার কেজি ১৯৬ গ্রাম ওজনের ৩৬টি সোনার বারসহ আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউজ।
ঢাকা কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো. সানোয়ারুল কবির জানান, এমিরেটসের একটি ফ্লাইট থেকে একটি বাক্সে করে সোনার বারগুলো পাচারে সহায়তা করার সময় ওই কর্মীকে হাতেনাতে আটক করা হয়।
গত মাসে শাহজালালে তিন কেজি ৪৮০ গ্রাম ওজনের ৩০টি সোনার বারসহ বিমানের নিরাপত্তা কর্মী ইব্রাহীম খলিল এবং যাত্রী কামাল উদ্দীনকে আটক করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ (এপিবিএন)।
জিজ্ঞাসাবাদে নিরাপত্তাকর্মী খলিল জানান, এই সোনার বার পাচার করতে পারলে প্রতিটি বারের জন্য তার ৬ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিল তার।
গত ১ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে বিমান বাংলাদেশের ওয়ার্কশপে একটি গাড়ির চাকার ভেতর থেকে ৪৬টি সোনার বার উদ্ধার করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এপিবিএন জানিয়েছে, গত ২ বছরে শাহজালাল থেকে ৮১ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে তারা। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জানায়, গত বছরের নভেম্বরে ৫৬ দশমিক ১৩৯ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। জব্দ করা এসব সোনার মূল্য ২৬ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা। ২০-২১ অর্থ বছরে এনবিআরের ঢাকা কাস্টমস হাউজ শাহজালাল থেকে ৪৯৪ দশমিক ৯২২ কেজি সোনা জব্দ করে, যার বাজার মূল্য ২৩০ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা।
গত এক মাসে শাহজালালে সোনা চোরাচালান করতে গিয়ে যারা আটক হয়েছে, এদের মধ্যে জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও যাত্রী যেমন রয়েছে তেমনি বেবিচক এবং বিমানের কর্মীও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১ মাস এবং ১ বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জব্দ হওয়া সোনার হিসাবই বলে দেয়, চোরাচালান একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সোনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে বেরিয়ে যায়। এজন্য চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালে সোনা চোরাচালান থামছে না। কয়েকদিন পর পরই কেজি কেজি সোনাসহ কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন চোরাচালানকারিরা। যারা ধরা পড়ছেন তারা সবাই বাহক। এদের পেছনে রয়েছে কয়েক ধাপের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দেশে যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিদেশেও। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
বেবিচক ও বিমান বলছে, যাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক জানান, আমরা যাদের সোনাসহ ধরি তাদের বেশিরভাগই যাত্রী। তারা সোনা বহনকারী। আটককৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, যে যাত্রী সোনা নিয়ে আসেন, এগুলো সাধারণত তার না বা তিনি এগুলো ব্যবসা করার জন্য কিনে আনেন না। গত বছর ১৪ কেজি লিকুইড সোনাসহ ৩ জনকে আটক করেছিলাম, তারা নিজেরা মালিক বলে স্বীকার করেছিলেন।
তিনি বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। একজন যাত্রী বাংলাদেশে আসার সময় বিদেশের এয়ারপোর্টে চোরাচালান সদস্যরা ওই যাত্রীকে কনভিন্স করে সোনা দিয়ে দেয় বলে এয়ারপোর্টে বা এয়ারপোর্টের বাইরে আমাদের লোক আছে তার কাছে দিয়ে দিলেই হবে। বিনিময়ে আপনি টাকা পাবেন। যাত্রী টাকার প্রলোভনে পড়ে আনতে রাজি হন।
জিয়াউল হক বলেন, যে সোনা বিমানে আসে, বিমানের বডিতে বা যাত্রী এনে বিমানের কোথাও লুকিয়ে রাখেন, সেই সোনাগুলো বের করে নিয়ে আসার সুযোগ শুধু বিমান বা বেবিচকের নির্দিষ্ট কিছু লোকজনের রয়েছে। বাইরের লোকজনের এয়ারপোর্টের স্পর্শকাতর জায়গা এপ্রোন সাইডে যাওয়ার সুযোগ নেই। অর্থের প্রলোভনে পড়েই হয় তো তারা এটা করেন।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের ডেপুট কমিশনার সানোয়ারুল কবির বলেন, অতীতের চেয়ে এখন যাত্রীদের স্ক্যানিং এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেসব রুটের ফ্লাইটে সোনা আসে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। কোনো ফ্লাইট ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে শতভাগ চেকিং করা হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। এসব কারণে শাহজালালে চোরাচালানীরা সোনা নিয়ে বের হতে গিয়ে ধরা পড়ছে।
সোনা চোরাচালান বিষয়ে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলি বলেন, বর্তমান অবস্থা আর আগের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে প্রায় প্রতিদিন সোনা চোরাচালান হতো। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সোনা চোরাচালান রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি। তার সুফল এখন পাচ্ছি। এখন নেই বললেই চলে, অলমোস্ট ৯৫ পারসেন্ট কমে গেছে। এটা একেবারে ভ্যানিশ করা যাবে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।