আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সাপকে খুব
ভয় পান। সাপ দেখলেই গা শিরশির করে উঠে। এ বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে, সাপ পৃথিবীর
অন্যতম বিষাক্ত এবং ভয়ংকর প্রানীর একটি। পৃথিবীতে প্রায় ৬শ’রও বেশি প্রজাতির
বিষাক্ত সাপ রয়েছে। তাদের মধ্যে ২শ’ প্রজাতির সাপ
মানুষের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
সাপের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী,
Animalia (প্রাণী) জগতের, কর্ডাটা (কর্ডটা) পর্বের, Vertebrata (মেরুদণ্ডী) উপপর্বের,
Sauropsida (সরোপ্সিডা) শ্রেণীর (শল্ক বা আঁশযুক্ত), Squamata (স্কোয়ামান্টা) বর্গের,
Serpentes (সার্পেন্টেস) উপবর্গের সদস্যদের সাপ বলে অভিহিত করা হয়। তবে বৈজ্ঞানিক
ও জেনেটিক পরির্বতন অনুসারে গিরগিট থেকেই সাপের জন্ম যার ইতিহাস ১৫ কোটি বছরের মত ।
( লেলিয়ান ফর্মুলা অনুসারে ) একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সকল মহাদেশেই সাপের উপস্থিতি
দেখা যায়। সাপের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গ্রোফ ও ২,৯০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে
এ পৃথিবীতে যা ১০ সে.মি. (থ্রেড সাপ) থেকে শুরু করে সর্বচ্চো ২৫ ফুট বা ৭.৬ মিটার
(অজগর ও অ্যানাকোন্ডা)। সম্প্রতি আবিষ্কৃত টাইটানওবোয়া (Titanoboa) সাপের জীবাশ্ম
প্রায় ৪৩ ফুট লম্বা হিসাবে দেখা গিয়েছে । তবে বেশীরভাগ প্রজাতির সাপ বিষহীন এবং যেগুলো
বিষধর সেগুলোও আত্মরক্ষার চেয়ে শিকার করার সময় বিভিন্ন প্রাণীকে ঘায়েল করতে বা নিজকে
বাঁচানোর জন্য সাপরা বিষের ব্যবহার প্রয়োগ করে ।
বিরক্ত করা ছাড়া সাপ সাধারণত কোন প্রানীকেই
আক্রমন করে না। এরা শুধু আত্নরক্ষার জন্যই ছোবল মারে। বাকি সাপের ছোবলে মৃত্যুর হাত
থেকে বেঁচে গেলেও এমন কিছু সাপ বিশ্বের নানা অলিগলিতে রয়েছে, যাদের এক ছোবলই হতে পারে
প্রাণনাশের কারণ। তেমন ১০টি বিষধর সাপ নিয়েই এবারের আয়োজন।
১। হাইড্রোফিলিস বেলচেরি (Hydrophis
Belcheri )
অনেকে ইনল্যান্ড তাইপানকে পৃথিবীর সবচেয়ে
বিষাক্ত সাপ হিসেবে ধারনা করলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হল বেলচেরি। প্রকৃতপক্ষে
এটি ইনল্যান্ড তাইপানের চেয়েও প্রায় ১০০ গুন বেশি বিষাক্ত।
সমুদ্রে বসবাসকারী এ সাপটি ০.৫ মিটার থেকে
১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর মাথা শরীর থেকে ছোট এবং এর পেছনে মাছের মত সাতারে
সহায়ক লেজ রয়েছে। এ সাপটি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে
বা ঘুমাতে পারে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপটি খুবই ভদ্র
স্বভাবের। এটি সাধারনত কাউকে কামড়ায় না। তবে বার বার একে বিরক্ত করলে এটি কামড় দিতে
পারে। এ সাপটি নিয়ে বেশি ভয়ের কারনও নেই কারন এটি কাউকে কামড়ালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
বিষ ডুকায় না। তবে কারো ভাগ্য খারাপ হলে এর বিষাক্ত ছোবলে ১৫মিনিটের কম সময়েই তার মৃত্যু
ঘটতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম বেলচেরির বিষ ১০০০ এর বেশি লোক বা ২৫ লক্ষ ইদুরকে
মারার জন্য যথেষ্ট্য।
০২। তাইপান সর্প পরিবার (Taipan Snake
Family)
সমগ্র পৃথিবীতে না হলেও ভূমিতে বসবাস কারী
সাপগুলোর মধ্যে তাইপান সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত এবং প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর প্রজাতির
সাপ।এর বিষাক্ত ছোবলে একজন মানুষ সর্বোচ্চ এক ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকারও কোন রেকর্ড
নেই।
তাইপান সর্প পরিবারের পাঁচটি উপ-প্রজাতির
মধ্যে ইনল্যান্ড তাইপান অনেক বেশি বিষাক্ত। ইনল্যান্ড তাইপানের ক্ষেত্রে এক ছোবলে সবচেয়ে
বেশি প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এর কয়েক মিলিগ্রাম বিষই ১০০
লোক বা প্রায় ২.৫ লক্ষ ইদুর মারার জন্য যথেষ্ট।
এ সাপগুলো ১.৮ মিটার থেকে ৩.৭ মিটার পর্যন্ত
লম্বা হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ংকর ধারনা করা হলেও এরা খুব সহজেই বশ মানে। তবে একে কোন কারনে
বিরক্ত করা হলে শিকার জায়গা থেকে নড়ার আগেই এটি প্রচন্ড বেগে কয়েক বার ছোবল দিয়ে দিতে
পারে।
০৩। ক্রেইট (Krait)
তাইপানের পর এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী
সাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত। এ সাপগুলো এশিয়ায় পাওয়া যায় এবং ৯০ সেন্টিমিটার
থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়।
এরা যেকোন সাধারন কোবরা থেকে প্রায় ১৫গুন
বেশি বিষাক্ত। দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও এরা রাতের বেলায় বের হয়। মানুষের শ্লিপিং
বেগ, বুট বা তাবুর নিচের লুকানো এই সাপের একটি বড় অভ্যস। ইন্ডিয়ান ক্রেইট ইন্ডায়ার
সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ।
০৪। ফিলিফাইন কোবরা (Philippine
Cobra)
ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর ৩য় সবচেয়ে বিষাক্ত
সাপ এটি। এরা প্রায় ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ক্রেইটের পরেই এরা সবচেয়
বিষাক্ত প্রজাতির সাপ। শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সাথে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় বলে ফিলিফাইনের
সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপগুলো সাপুড়েরা সাপের নাচ দেখানোর সময় বেশি ব্যবহার করে। সকল কোবরার
মত এরাও রেগে গেলে মাথার দুইপাশে হুড দেখা যায়।
০৫। ইন্ডিয়ান কিং কোবরা (King kobra)
ভূমিতে বসবাসকারী সাপের মধ্যে ৪র্থ বিষাক্ততম
সাপ হল ইন্ডিয়ান কোবরা। ফিলিফাইন কোবরার পর এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ। এর সাধারনত
৩.৫ মিটার থেকে ৫.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। এর পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে
বড় হলেও এরা মানুষকে তুলনামুলক কমই কামড়ায়। এ সাপ ছোবলের ভয়ে অন্য বিষাক্ত সাপগুলোকে
আক্রমন করে না। তবে অবিষাক্ত সাপই এদের অন্যতম প্রধান খাদ্য।
এর বেশি ক্ষুধার্ত হলে বিষাক্ত সাপকেও
এমনকি নিজের প্রজাতির সাপকেও হজম করে। এরা জংলি প্রজাতির এবং সাপের খাদক হিসেবে পরিচিত।
এরা ছোবলের সময় যেকোন সাপ থেকে বেশি বিষ নিক্ষেপ করে । স্ত্রী কিং কোবরা এর ডিমের চারপাশে
বাসা বাঁধে। এর বাসার কাছাকাছি কিছু এলে এটি অস্বাভাবিক আক্রমনাত্নক আচরন করে। কিং
কোবরা খুবই গভীল জঙ্গলের অধিবাসী।
০৬। রাসেলস্ ভাইপার (Russell’s Viper)
ভয়ংকর দর্শন এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী
পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে পঞ্চম। এটি খুবই রাগী ধরনের সাপ। সম্ভবত অন্য যেকোন
বিষাক্ত সাপের চেয়ে এ সাপই মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে।
এটি কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং এত প্রচন্ড
বেগে শিকারকে ছোবল মারে যে পালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় থাকে না। এর বিভিন্ন প্রজাতি
রয়েছে যারা খামার বাড়ি থেকে শুরু কলে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে।
এরা সাধারনত ১ মিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে।
০৭। ব্লাক মাম্বা (Black Mamba)
আফ্রিকার আতংক এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী
সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে ৬ষ্ঠ। এরা আক্রমনের জন্য খুবই কুখ্যাত। এরা আফ্রিকার
সবচেয়ে ভয়ংকর সাপ এবং সাধারন মানুষ এদের থেকে যথেষ্ট সম্মানের সাথেই দূরে থাকে। এটি
শুধু প্রচন্ড বিষাক্তই নয় প্রচন্ড আক্রমনাত্নকও।
এর কামড় থেকে শিকারের বাঁচার সম্ভাবনা
খুবই কম। এটি ভূমিতে বসবাসকারী সকল সাপ থেকে দ্রুত গতির এবং ঘন্টায় প্রায় ১৬ থেকে ১৯
কি.মি. যেতে পারে। এর বিভিন্ন প্রজাতিও খামারবাড়ি থেকে গভীর বন পর্যন্ত ছড়িযে ছিটিয়ে
বাস করে। এ প্রজাতির সাপগুলো প্রায় ৪.৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
০৮।হলুদ চোয়াল বিশিষ্ট্য টম্মিগফ
(Bothrops Asper)
স্থানীয় ভাবে ফার-ডি-ল্যান্স নামে পরিচিত
এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী সাপগুলো মধ্যে ৭ম বিষাক্ত। এরা প্রচন্ড রাগী ধরনের সাপ এবং
সামান্য উত্তেজিত করলেও প্রচন্ড ছোবল মারতে পারে।
এ সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর হার খুবই
বেশি।এ সাপের কামড়ে মানুষের দেহকোষ এত মারাত্নক ভাবে ধ্বংস হতে থাকে যে শরীরে পঁচন
দেখা দেয়। সাধারণত কৃষি জমি এবং খামার বাড়িতে এদের দেখা যায়। এর গড়ে ১.৪ মিটার থেকে
২.৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
০৯। মাল্টি–ব্র্যান্ডেড ক্রেইট
(Multibanded krait)
এটি ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত
সাপের মধ্যে ৮ম। সাধারন ক্রেইটের মত এরাও রাতের বেলা খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে। এদেরকে সাধারণত
জলাভূমিতে মাছ, ব্যঙ্গ বা অন্য সাপের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। এরা গড়ে ১.৮ মিটার
পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চীন ও ফিজিতে এদের বেশি দেখা যায়।
১০। টাইগার স্নেক(Tiger Snake)
এরা ভূমিভিত্তিক পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত
সাপগুলোর মধ্যে ৯ম। এরা অস্ট্রেলিয়া বসবাসকারী একধরনের সাপ যারা শরীর প্রচুর পরিমানে
বিষ তৈরী করতে পারে। এদেরকে শুষ্ক অঞ্চল, তৃনভূমি, জলাভূমি, মানববসতি সব জায়গায়ই দেখা
যায়। এরা সাধারণত ১.২ মিটার থেকে ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
সাপ থেকে নিজে বাঁচতে বা সাপের পথ রোধ
করতে কি কি করতে পারেন ?
সাপ কে ধ্বংস করার পদ্ধতি আইন গত ভাবে
সম্পূর্ণ অবৈধ বিধায় তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। তবে সাধারণত যদি কোন কারনে বারে বারে
আপনার বাড়ির আঙিনায় সাপ চলে আসে তখন মনে করতে হবে, আসে পাশের কোথায় তার ভাল খাবার অথবা
ডিম পেরেছে ( ব্যাঙ বা ইঁদুর ) । সে জন্য আপনার ঘরে যাতে সাপ না ঢুকে খুব সতর্ক থাকতে
হবে, বিশেষ করে রুমের চার পাশে ইদুরের গর্ত থাকলে তা বন্ধ করবেন এবং প্রয়োজনে রুমের
চার পাশে কাচা রুসুন মিশ্রিত পানি বা পেইস্ট রাখলে এর কয়েক ফুট স্কয়ারে সাপ আসেনা
( প্রমাণিত ), তার পর ও যদি মনে ভয় থাকে তা হলে বাসা বাড়িতে কার্বলিক এসিড ব্যবহার
করুন, দেখবেন এ দিকে সাপ আসবে না ( কার্বলিক এসিড ব্যবহার করার সময় খেয়াল রাখবেন অন্য
কেউ যেন খেয়ে না ফেলে ), সাপ পাহারাদার হিসাবে সবচেয়ে বড় বন্ধু ঘরের বিড়াল এবং বাড়ির
কুকুর, তাই যাদের ঘরে বিড়াল থাকে তাদের ঘরে সাপ ঢোকতে খুব কস্ট হয়, সে রকম যে বাড়িতে
কুকুর থাকে সেই বাড়ির আঙিনা বা এর আশে পাশে সাপ আসা ও খুব কস্টের বিষয় । অবশ্য কেউ
কেউ রাতে হাটার সময় সাপ যে সব এরিয়ায় থাকে সেই এরিয়ার দিকে গেলে জোরে জোরে পা দাপিয়ে
বা হাত তালি দিয়ে হাঁটেন, যাতে বাতাসে স্পন্দনে সাপরা টের পায় কেউ আসছে এবং তারা পথ
থেকে সরে যায় । সেই যুক্তিও একেবারে খারাপ নয় । আগে পরীক্ষা না করে কোন অন্ধকার জায়গা,
পাথরের ফাঁকা জায়গা বা গাছের ছিদ্রে হাত দিবেন না । যে কোন কারনে সাপ সামনে চলে আসলে
নড়া চড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকার চেস্টা করবেন এতে অনেক সময় সাপ তার নিজ পথে চলে যায় ।
পাথরের সাহায্যে কোন সাপ মারতে যাওয়া উচিত নয়। কারন এক্ষেত্রে সাপটি আকস্মিকভাবে জাম্প
করে আপনাকে ছোবল মারতে পারে বা বিষ ছুড়ে দিতে পারে। বাড়ির আশপাশের এলাকা ইঁদুর ও ব্যাঙ
মুক্ত রাখার চেষ্টা করবেন । বাড়ির আশে পাশে মাঠের ঘাস নিয়মিত ছেঁটে ছোট রাখলে অনেক
সময় সাপ আসলে সবার চোখে পড়বে বিধায় সাপ দূরে থাকার চেষ্টা করে ।