মাত্র ২০ দিনের
মাথায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সিলেট। টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিলেটে চলমান
দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি। মহানগর ও জেলাজুড়ে
প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে মহানগরের ১৫টি এলাকার ১০ হাজার মানুষ
বন্যাকবলিত। বন্যায় ঝুঁকিতে পড়েছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার বিদ্যুতের
সাবস্টেশন। সুরমা নদী ছাপিয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এটি
প্লাবিত হলে দক্ষিণ সুরমার প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়তে পারেন।
মঙ্গলবার বিকাল
থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। তাদের সহায়তা করছে সিলেট
সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ। নদীর পাড়ে বালির বস্তা ফেলে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন
তারা।
গত ২৭ মে সিলেটে
আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে ৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত
হন। সেই বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই গত শনিবার ফের কবলিত সিলেট।
সোমবার ঈদের
দিন ভোর রাত থেকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। সাথে নামে পাহাড়ি ঢল। সকাল হতে না হতেই
তলিয়ে যায় মহানগরের অনেক এলাকা। জেলার বিভিন্ন স্থানেও অবনতি হয় বন্যা পরিস্থিতির।
সোমবার বিকালে বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে কিছুটা কমে পানি। কিন্তু মঙ্গলবার ভোররাত থেকে
ফের শুরু হয় বৃষ্টি। উজানেও বৃষ্টিপাত হয় প্রচুর। ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে সিলেটের
সব নদ-নদীর পানি। ঈদের দিন দুটি নদীর পানি ২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও মঙ্গলবার
সকালে ৪টি নদীর পানি ৬ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিকালে জেলা ও
মহানগরের বিভিন্ন জায়গায় পানি আরও বেড়েছে।
চৌকিদিঘির বাসিন্দা
মতিন মিয়া জানান, ‘ঘরে কোমর পানি, আমার পরিবার গাঙ্গের হপাড় রাইক্কা আইছি আশ্রয়কেন্দ্রত।
একবারে নিরাশ অবস্থা, খাবারদাবার কিচ্ছুই নাই। এই অবস্থার মাঝে আছি। আমরা বারবার ভোগান্তির
শিকার হইরাম। কেউ দেখেরও না। সরকারের পক্ষ থাকিও কুন্তা দেয়া ওর না।’
এছাড়া সারি
নদীর সারিঘাট পয়েন্টে পানি বইছে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। আর সারি-গোয়াইন
নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০.২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন
জানিয়েছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সিলেটজুড়ে ৮৬৪টি গ্রাম ও এলাকা প্লাবিত। এসব গ্রাম ও এলাকার
৬ লাখ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন বন্যা আক্রান্ত। এর মধ্যে সিলেট মহানগরের ৪টি ওয়ার্ডের ১০
হাজার মানুষ পানিবন্দি। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে
মহানগরে ৮০টি।
সরেজমিনে দেখা
যায়, মহানগরের সব নিচু এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। বিশেষ করে শাহজালাল উপশহর প্রায় পুরোটাই
পানির নিচে। অনেকের বাসার নিচতলায় গলা পর্যন্ত পানি। এছাড়া যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ,
রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, তালতলা, জামতলা, কাজিরবাজার, মাদিনা
মার্কেট, আখালিয়া ও মেজরটিলাসহ মহানগরের অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত।
এছাড়া মহানগরের
মধ্যে অনেক প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পানি রয়েছে। এয়ারপোর্ট সড়ক, সিলেট-তামাবিল সড়ক,
দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডসহ বিভিন্ন সড়কের বেশ কয়েকটি স্থান পানির নিচে। এদিকে মহানগর
পুরোটা না হলেও জেলার সব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে,
গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাটসহ কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে
যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে
পুকুরের মাছ।
জেলা প্রশাসন
সূত্র জানায়, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারের লক্ষ্যে
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি
পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে
কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ডেডিকেটেড অফিসার নিয়োগের পাশাপাশি
প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের
জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামী ৩ দিন সিলেট
অঞ্চলে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
হবে।
পানি উন্নয়ন
বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ সময় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে
সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর সিলেট
পয়েন্টে পানি বইছে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। কুশিয়ারা নদীর আমলশীদ পয়েন্টে
বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি
বইছে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
সিলেট আবহাওয়া
অফিস জানিয়েছে, সিলেটে ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার ৬টা পর্যন্ত) ১৫৩
মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৭৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
হয়েছে। আগামী তিন দিন সিলেটে টানা বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে দুর্যোগ
ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোঃ মহিববুর রহমান বুধবার দিনভর সিলেট নগরীর বিভিন্ন
বন্যা কবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে মিরাবাজার কিশোরী মোহন বালক বিদ্যালয় আশ্রয়
কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করেন।
এসময় নগরীর
বন্যা পরিস্থিতি দেখে তাৎক্ষণিক নগদ ১০ লক্ষ টাকা, ১ শ' মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট
শুকনো খাবার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেন প্রতিমন্ত্রী।
ত্রাণ সহায়তায়
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখা
দেয়ার পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যার
খবর রাখছেন। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্না করা খাবার বিতরণ করছে
সিটি কর্পোরেশন। পানি না কমা পর্যন্ত আমাদের ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
এসময় সাবেক
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমেদ,
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল ইসলাম, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী,
এনডিসি, সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী
কর্মকর্তা মো: ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।