অবরুদ্ধ গাজায় যখন প্রতিনিয়ত
মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তখনো ১৩ হাজারের বেশি মানুষের কোন সন্ধান নেই, এক রকম
নিখোঁজ তারা। এদের অনেকে হয়তো এখনো ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে, কিন্তু অনেক
মানবাধিকার সংস্থা বলছে বাকি অনেকেই সম্ভবত ‘গুমের’ শিকার হয়েছেন। আহমেদ আবু ডিউক তার ভাই মুস্তাফাকে
খুঁজে বেড়াচ্ছেন মাসের পর মাস ধরে। যুদ্ধের কারণে শরণার্থী হওয়া এই পরিবারটি এখন খান
ইউনিসের দক্ষিণে নাসের হাসপাতালের সামনের উঠানে আশ্রয় নেয়।
কিন্তু তারা যখন
জানতে পারে যে কাছেই তাদের ঘর আগুনে পুড়ে গিয়েছে, তখন সেটার অবস্থা জানতে ওখানে যান
মুস্তাফা। এরপর তিনি আর কখনোই ফিরে আসেন নি। ‘আমরা যতটা পারি খুঁজেছি’, আহমেদ বলছিলেন একসময় যেখানে তাদের
বাড়ি ছিল সেটা এখন পুড়ে যাওয়া এক ধ্বংসস্তুপ। ‘আশেপাশের সব বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং অনেক
উঁচু উচুঁ ভবন মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে,’ বলেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের
চালক মুস্তাফার খোঁজ চালাতে থাকে পরিবার, হামাস নিয়ন্ত্রিত সিভিল ডিফেন্সের দল ধ্বংসস্তুপের
নিচ থেকে যেসব মৃতদেহ উদ্ধার করেছে সেখানে এবং নিকটস্থ গণকবরগুলোতে, কিন্তু তার দেখা
পাওয়া যায় নি। ‘আমাদের এখনো
আশা যে হাসপাতালে প্রতিনিয়ত যেসব অ্যাম্বুলেন্স আসছে তার কোন একটাতে আমরা খুঁজে পাব
তাকে,’ বলেন আহমেদ।
হামাস নিয়ন্ত্রিত
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছে
সেটি ৩৫ হাজারের বেশি, কিন্তু সংখ্যাটা শুধুমাত্র হাসপাতাল থেকে যে মৃতের সংখ্যা জানা
গিয়েছে তার উপর ভিত্তি করে। মুস্তাফাদের মতো এমন অনেক পরিবার আছে যারা আসলে জানেনা
গত সাত মাসে নিখোঁজ হওয়া তাদের প্রিয়জনেরা কোথায় আছে, কেমন আছে।
গত ৭ই অক্টোবর
ইসরায়েলের সীমান্ত পেরিয়ে হামাসের এক অতর্কিত হামলায় ১২০০ জন মারা যায় ও ২৫২ জনকে বন্দী
করা হয়। জবাবে ইসরায়েল এক সামরিক অভিযান শুরু করে।
জেনেভা ভিত্তিক
একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের মতে, এই অভিযানে হাজার হাজার
মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি ১৩ হাজারের উপর ফিলিস্তিনি নিখোঁজ হয়েছে, তাদের কোন সন্ধানই
আর নেই। এই পরিসংখ্যানে কতজন হামাস যোদ্ধা ও কতজন সাধারণ নাগরিক আছে তা আলাদা করা
নেই।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের
নিরাপত্তা সংস্থার অংশ গাজার সিভিল ডিফেন্সের হিসেবে ১০ হাজার উপর মানুষ শুধু এসব ধ্বংস
হওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে।
জাতিসংঘ হিসেব
দিয়েছে গাজা উপত্যকাজুড়ে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে তার পরিমাণ হবে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন
টন আর এর নিচে যেরকম শরীর চাপা পড়ে আছে তেমনি প্রায় আরও সাড়ে ৭ হাজার টন অবিস্ফোরিত
গোলাবারুদ আছে, যা স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণকর্মীদের জন্য আরেকটা ভয়াবহ হুমকি।
সিভিল ডিফেন্স
বলছে তারা তাদের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে চাপা পড়া শরীর
উদ্ধারে কাজ করছেন, কিন্তু তাদের খুবই সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি আছে যাতে প্রায়শই মৃতের
শরীরে কাছে পৌঁছানোটা কঠিন হয়ে যায়।
এছাড়া আরেকটা
শঙ্কাও আছে যে শরীর যদি না ঢেকে নিচে ওভাবেই পচাঁ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তাহলে সামনে
গরম যখন আরও বাড়বে তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। আবদুর রহমান
ইয়াঘি নিচে চাপা পড়া তার আত্মীয়ের শরীর বের করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
মধ্য গাজার দেইর
আল বালাহ শহরে তাদের পরিবারের একটি তিনতলা বাড়ি ছিল, ২২শে ফেব্রুয়ারি যখন এতে মিসাইল
আঘাত হানে তখন তার পরিবারের ৩৬ জন সদস্য সেই বাড়িতে ছিলেন। তিনি জানান ১৭টা মৃতদেহ
তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন, এছাড়া শরীরের যেসব অংশ বিশেষ পাওয়া গিয়েছে সেগুলো শনাক্ত
করা যায় নি।
‘আমরা বাড়িতে
থাকা বেশির ভাগ শিশুর মৃতদেহ খুঁজে পাই নি,’ বলেন তিনি। সিভিল ডিফেন্স জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ যাদের
উদ্ধার কাজে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী কর্মী আছে তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন
জানিয়েছে।
তারা আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন সংস্থার কাছেও আবেদন করেছে যাতে এক্ষেত্রে ‘জরুরি হস্তক্ষেপ’ করা হয় এবং ইসরায়েলের উপর চাপ দেয়া হয়
যাতে তারা গাজায় উদ্ধারকাজের জন্য ভারী যন্ত্রাপাতি আসার অনুমতি দেয়, কিন্তু তাদের
সেই আবেদনে এখনও কোন সাড়া মিলেনি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
বিশ্বাস যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদেরকে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) তাদের
পরিবারকে অন্ধকারে রেখে আটক করে থাকতে পারে, যেটাকে তারা বর্ণনা করছে ‘গুম’ হিসেবে।
ইউরো-মেড হিউম্যান
রাইটস মনিটরের হিসেবে আইডিএফ পরিবারদের না জানিয়েই গাজার শত শত ফিলিস্তিনকে আটক করেছে।
কিন্তু জেনেভা কনভেনশন, যেটাতে ইসরায়েলও স্বাক্ষর করেছে, সেখানে বলা আছে একটা দেশ যদি
কোন বেসামরিক নাগরিককে আটক করে রাখে তাহলে তার পরিচয় ও তাকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটা
জানাতে হবে।
গত ৭ই অক্টোবরের
হামলার পর থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের আটক কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির
সমস্ত পরিদর্শন বাতিল করেছে। গাজায় রেডক্রসে কর্মরত হিশাম মুহানা বলেন, ‘আমরা বারবার ফিলিস্তিনিদের যেখানে ধরে
রাখা হয় সেখানে প্রবেশাধিকার চেয়েছি কিন্তু আমাদের সেই অনুমতি এখনো দেয়া হয় নি।’
আন্তর্জাতিক রেডক্রস
কমিটি জানায় ইসরায়েলি বন্দীদের রাখা হামাসের আটককেন্দ্রেও তারা যাওয়ার অনুমতি পায়নি।
এ ব্যাপারে বিবিসি আইডিএফের কাছে মন্তব্য জানতে চেয়ে কোনও উত্তর পায়নি। তবে সামাজিক
মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে ইসরায়েলের জাতীয় নিরপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির লিখেছেন,
‘ইসরায়েলে বন্দী করে রাখা হামাস যোদ্ধাদের
ব্যাপারে রেডক্রসকে কিছুই জানতে দেয়া হবে না, যতক্ষণ না তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে আমাদের
যাদের বন্দী করে নেয়া হয়েছে গাজায়, তাদের ব্যাপারে কোন তথ্য না জানাতে পারবে: মানবিকতার
বিনিময়েই কেবল মানবিকতা।’
মধ্য গাজার আরেকটা
শহর আল জুয়াইদাতে আরেকটা পরিবার তাদের হারানো সন্তানের সন্ধানে রয়েছে। তাদের ভয় তাদের
সন্তানকেও হয়তো ‘গুম’ করা হয়েছে।
মোহাম্মদ আলীর
মা, তার সন্তানের একটা ছবি হাতে নিয়ে ততদিন পর্যন্ত খুঁজেছেন যতদিন না তাকে কেউ বলেছে
যে তার ছেলেকে আইডিএফ ধরে নিয়ে গিয়েছে। তারা বলছে যে শেষবার জীবিত অবস্থায় তার সাথে
দেখা হয়েছে কিন্তু তারা এরপর আর জানে না যে তার কি হয়েছে।
গত ২৩ শে ডিসেম্বর
যখন উত্তর গাজার জাবালিয়ায় মারাত্মক বোমাবর্ষণ শুরু হয়, তখন এই পরিবারটি আশ্রয়ের খোঁজে
নিজ বাসা ছেড়ে একটা স্কুলে এসে উঠে, আর সেদিন থেকেই মোহাম্মদের কোন খোঁজ নেই।
মোহাম্মদের স্ত্রী
আমানি আলী বলেন, একপর্যায়ে ইসরায়েলি সেনারা স্কুলেও ঢুকে পড়ে এবং নারী ও শিশুদের সেখান
থেকে চলে যেতে বলে। তিনি বলেন এরপর সেই রাতে সব পুরুষরা তাদের পরিবারের কাছে ফেরত আসলেও
মোহাম্মদ আর আসেনি। সে কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই তারা আর জানে না।
আমানি বলছিলেন
তিনি বুঝতে পারছেন না যে তার স্বামী কি মারা গিয়েছে নাকি তাকে আইডিএফ ধরে গিয়েছে, আর
একারণেই তার বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ আশা এখনো রয়ে গিয়েছে তার। আমানির বিশ্বাস, ‘যদি সে বেঁচে থাকতো ও মুক্ত থাকতো তাহলে
সে ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করতো।’
হামাস নিয়ন্ত্রিত
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিবারগুলোর জন্য একটা অনলাইন ফর্ম তৈরি করেছে যেখানে তারা মৃত
ও নিখোঁজদের ব্যাপারে জানাতে পারে, যাতে করে ৭ই অক্টোবর থেকে যারা নিখোঁজ তাদের
ব্যাপারে একটা পরিপূর্ণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা যায়। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে না জানা
পর্যন্ত অনেক পরিবারই তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরবে।