২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু এ বছর পুরো ব্যাংক খাতের জন্য কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি। অর্থাৎ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। কিছু কিছু ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিতরণ করেছে। আবার কিছু ব্যাংক কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রায় অর্জন করতে পারেনি। এরকম ব্যর্থ ব্যাংকের সংখ্যা আটটি।
আগামীকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনের চতুর্থ তলায় জাহাঙ্গির আলম কনফারেন্স হলে কৃষিনীতি ঘোষণা করা হবে। সকাল ১১ টায় ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান।
বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রোববার কৃষিনীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের তুলনায় এই বছর ব্যাংকিং খাতে কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনুমোদনপ্রাপ্ত এমএফআই প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষুদ্রঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা আছে ২৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের ফলে কৃষকদেরও ২৪ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। যদিও এই সুদের হার ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্র জানিয়েছে, মোট কৃষিঋণের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে এবার।
দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে প্রতিবছর কৃষি ও পল্লীঋণ নামে নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য পৃথক পৃথক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নও তদারকি করা হয়। প্রথা অনুযায়ী এবারও কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণের নীতিমালা শিগগিরই জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় অন্য ঋণের চেয়ে কৃষি ও পল্লীঋণের সুদহার তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে সুদহার নির্ধারণ করা ছিল সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ। তবে সব কৃষক এই সুদহারে ঋণ পাননি। কারণ ব্যাংকগুলোর এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) নির্ভরতার কারণে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের ঋণ পেতে গুনতে হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকরা প্রকৃত অর্থে লাভবান হচ্ছেন, নাকি আরও ক্ষতির মুখে পড়ছেন- সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মধ্যে।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের নীতিমালায় অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের (এমএফআই) সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতে অন্তত ৭০ শতাংশ কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের সুযোগ রাখা হয়। অর্থাৎ ব্যাংক সরাসরি কৃষককে ঋণ দিলে যে সুদ পাবে, একই সুদ পাবে এমএফআই প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিলেও। আর ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণ গ্রাহকপর্যায়ে বিতরণের সুদের হার এমআরএ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। তবে এবার কৃষিঋণ বিতরণে বেসরকারি ব্যাংকের এনজিও-নির্ভরতা কমাতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করলে কৃষকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সুদে ঋণ পান। আবার ঋণের গুণগত মান বজায় রাখাও সম্ভব হয়। এই বিবেচনায় কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর। আর চলতি অর্থবছরের নীতিমালায়ও সেটি গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, এনজিও-নির্ভরতা কমাতে বেসরকারি ব্যাংকের নিজস্ব শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। নিজস্ব নেটওয়ার্কে ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘অ্যাগ্রি ক্রেডিট সুপারভাইজার’ পদের এসব কর্মী দিয়ে ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ ছাড়া অন্য কোনো সেবা দিতে পারবে না। গত ২৩ জুন এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনজিওর মাধ্যমে ঋণ দিলে সুদ একটু বেশি হবে। তবে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ কৃষকের জন্য অনেক বেশি। এত বেশি সুদ নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তার পরও কৃষকরা এনজিও থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী। কারণ এখানে ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ফরমালিটিস (বাধ্যবাধকতা) থাকে না। এনজিওগুলো কৃষকের দৌরগোড়ায় ঋণটি পৌঁছে দেয়।
চলতি অর্থবছরের অন্যান্য ঋণের সঙ্গে কৃষিঋণের সুদহারের সীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে কৃষিঋণের সুদহারও নির্ধারিত হবে ‘সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট পদ্ধতিতে। নতুন এ নিয়মে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে কৃষিঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। এ নিয়মে জুলাই থেকে কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এতে ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করলেও সুদহার ১ শতাংশের বেশি বাড়বে। তার পরও এনজিও-নির্ভরতায় বিতরণ করা ঋণের সুদের তুলনায় এটি অনেক কম।