এক বছর আগে ভলোদোমির জেলেনেস্কি এবং তার ইউনিটের সৈন্যরা তাদের বিএম-২১ গ্রাড রকেট লঞ্চার দিয়ে একবারে ৪০টি গোলা ছুঁড়তো। কিন্তু এখন একসঙ্গে ৪০টি ব্যারেলের মাত্র অল্প কটি ব্যবহার করতে পারছে তারা। আমাদের কাছে যথেষ্ট গোলা নেই, বলেন জেলেনেস্কি।
কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুত শহরে কোণঠাসা হয়ে পড়া ইউক্রেনীয় সৈন্যদের সাহায্যের জন্য তার সপ্তদশ ট্যাংক ব্যাটালিয়ন ইউনিটের নিয়মিত ডাক পড়ে। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া ইউক্রেনের কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এখনো সেই লড়াইয়ের জয়-পরাজয়ের ফয়সালা হয়নি, তবে রুশরা এখন তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি।
রুশদের চোখ এড়াতে জঙ্গলের মধ্যে গাছের আড়ালে যখন আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছি, জেলেনেস্কির কাছে কল আসে যে ১৫ কিলোমিটারের দূরে যে জায়গা থেকে রুশরা মর্টার ছুঁড়ছে সেটি টার্গেট করে রকেট ছুড়তে হবে।
আরও পড়ুন: উত্তর কোরিয়াকে উসকে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডালপালা
দিয়ে ঢাকা সাঁজোয়া যানটি প্রস্তুত করতে শুরু করে দিল সৈন্যরা। ডালপালা সরিয়ে ফেলে এক
কিলোমিটার দূরে একটি খোলা মাঠের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো গাড়িটিকে। তারপর তার ওপর বসানো
রকেট লঞ্চারের ব্যারেলগুলো টার্গেট করা হলো। মাথার ওপর একটি ইউক্রেনীয় ড্রোন উড়ছিল
যার সাহায্যে শত্রুর অবস্থান যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে নিশানা করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
গোলা ছোঁড়ার পর তাদের জানানো হলো টার্গেট থেকে রকেট ৫০ মিটার দূরে গিয়ে পড়েছে। সেইমত ব্যারেলের উচ্চতা এবং নিশানা সমন্বয় করে আরও দু-দফা গোলা ছুঁড়ে দ্রুত গাড়িটিকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে আসা হলো। পরপরই তাদের জানানো হলো, রকেট টার্গেটে আঘাত করেছে।
তবে জেলেনেস্কি কিছু হতাশ কারণ যতটা প্রয়োজন সেইমত লড়াই করা সম্ভব হচ্ছেনা। আমাদের সৈনিকরা সেখানে প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের আমরা আরও সাহায্য করতে পারতাম। ইউক্রেনের গ্রাড রকেটের মজুদ প্রায় শেষের পথে। তাদেরকে এখন অন্য দেশ থেকে আসা সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: শিগগির রাশিয়ান তেল পাকিস্তানে আসছে
জেলেনেস্কি জানালেন সেই গোলা এখন আসছে চেক বিপাবলিক, রুমানিয়া এবং পাকিস্তান থেকে। তিনি বলেন, পাকিস্তান থেকে যেগুলো আসছে সেগুলোর মান ভালো নয়। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, অস্ত্র ও গোলার জন্য ইউক্রেন তত বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার ওপর ব্যাপক পাল্টা হামলা এখন ইউক্রেনের প্রধান লক্ষ্য, তবে একইসঙ্গে তাদেরকে বর্তমান অবস্থানও ধরে রাখতে হচ্ছে।
যদিও বাইরে থেকে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানসহ অনেক আধুনিক অস্ত্র আসছে, তবে ইউক্রেন এখনও সোভিয়েত জমানার অস্ত্র-গোলা-বারুদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল । বাখমুটের কােছ জঙ্গলে লুকানো বুক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী ইউনিট
তাদের কাছে এমনকি রাশিয়ার তৈরি বুক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে - যা দিয়ে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন ধ্বংস করা যায়। কাছেই জঙ্গলের ভেতর গোপনে মোতায়েন তেমন একটি বুক ইউনিট দেখানো হয় আমাদের। এই বুক বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কারণে রাশিয়া এখনও ইউক্রেনের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
আরও পড়ুন: ইরান ও সৌদি আরব বাণিজ্য পুনরায় শুরু
বুক ইউনিটের কম্যান্ডার জোসেফ বললেন, এই
অস্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া এখন রুশদের এক নম্বর টার্গেট। ফলে এটি রক্ষায় তারা সর্বোচ্চ
সাবধানতা অবলম্বন করছেন। লম্বা একটি ট্রাকের ওপর বসানো বুকের রেডারটিকে একটি গর্তের
ভেতর ঢুকিয়ে ডালপালা এবং জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। গাড়ির ওপরে দুটো ধুসর রংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র
ফিট করা।
কম্যান্ডার সেরহির আশংকা পাঁচ-দশ বছর এই
যুদ্ধ চললে তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ইউক্রেনের থাকবে না। এ মাসের প্রথম দিকে ফাঁস হওয়া
মার্কিন গোপন নথিতে ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য এবং বিশ্লেষণ রয়েছে।
ইউক্রেনের বুক ক্ষেপণাস্ত্রের চরম ঘাটতির কথা রয়েছে মার্কিন ঐ নথিতে। সে প্রসঙ্গ তুলতে সেরহি উত্তর দিলেন, একথা সত্যি নয়। তবে তিনি স্বীকার করলেন বুক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা সচল রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়, কিন্তু আমাদের কাছে সেগুলো নেই, কারণ যেসব কারখানায় এসব যন্ত্রাংশ তৈরি হয় সেগুলো ইউক্রেনে নয়।
জোসেফের মতে আমেরিকার গোপন নথিতে এমন কিছু নেই যেগুলো অজানা। তিনি মনে করেন ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সম্পর্কে রাশিয়া সবসময়ই অবগত। তবে রাশিয়া এখনো জানেনা কোথায় এবং কখন ইউক্রেনীয় বাহিনী পাল্টা হামলা চালাবে। এবং সেই পাল্টা হামলা করেই ইউক্রেনের পক্ষে ৮০০ মাইল লম্বা রণাঙ্গনে চাপ কমানো সম্ভব হবে, হারানো কিছু জায়গা পুনর্দখল সম্ভব হবে।
কিন্তু সেই পাল্টা হামলার জন্য ইউক্রেনের
আরও অস্ত্র এবং সরঞ্জাম দরকার। দুপক্ষই এখন রণাঙ্গনে শক্তি ধরে রাখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
বাখমুটের অন্য একটি অংশে রুশ সৈন্যদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট দিনে শত শত রাউন্ড গোলা ছুড়ছে। তারা পশ্চিমাদের দেওয়া কিছু অস্ত্রও ব্যবহার করছে সেখানে। যেমন সেরহি এবং তার ইউনিট ব্রিটেনের তৈরি এল-১১৯ কামান ব্যবহার করছে। তবে হিসেব করে গোলা ছুড়তে হচ্ছে, দিনে বড় জোর ৩০ রাউন্ড।
আরও পড়ুন: এক কেজি গাঁজার জন্য ঝুলতে হলো ফাঁসিতে
আমাদের এখন যথেষ্ট লোক রয়েছে, কিন্তু আমাদের দরকার গুলি। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গুলির, তিনি বলেন। জয়-পরাজয়ের জন্য এই বছরটি ইউক্রেনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সেহরির উত্তর ছিল, এবছর যদি আমরা পাল্টা হামলা চালাতে পারি এবং দখল হওয়া জমি নিয়ে নিতে পারি, তাহলে এই যুদ্ধে আমরা জিতবো। কিন্তু তা যদি না হয়, তাহলে আরও পাঁচ-দশ বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদ ইউক্রেনের নেই।
গ্রাড কম্যান্ডার জেলেনেস্কি ছিলেন আরও
স্পষ্ট। দেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির অবস্থাও বেহাল। তার ভয় এ বছর যদি যুদ্ধক্ষেত্রে
ইউক্রেন বড় কোনো সাফল্য না দেখাতে না পারে, তাহলে পশ্চিমা সাহায্য কমে যেতে পারে। আমাদের
ভয় হচ্ছে যে পশ্চিমা মিত্ররা আমাদের সাহায্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, বলেন তিনি।