উপকূলীয় জেলা
বাগেরহাটের মানুষ প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও আম্পানের পর আরো একবার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের
তাণ্ডব দেখল। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলবাসীর ঘরবাড়ি, জলোচ্ছ্বাসে
ভাসিয়ে নেয় মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত। রক্ষা পায় না বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এবারও
তার ব্যতিক্রম । ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূল অতিক্রম করার পর যতই সময় গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট
হচ্ছে ধ্বংসলীলার ক্ষত চিহ্ন।
রবিবার বিকাল
থেকে শুরু হয়ে সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত তান্ডব চালিয়ে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের মোংলা,
শরণখোলা, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া ও বাগেরহাট সদরসহ প্রায় সব কটি উপজেলায় ক্ষতচিহ্ন
রেখে গেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রমের একদিন পেরিয়ে গেলেও বহু মানুষ
পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে এখনো। গাছ পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে এ জেলায়।
বাগেরহাটের
শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সময়ে গাছ
চাপায় ফজিলা বেগম (৫০) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়।
শরণখোলা উপজেলার
খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, প্রতিবছর
আমাদের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। রবিবার
বিকাল থেকে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হয়ে সোমবার পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ফলে আমাদের
এলাকায় বহু মানুষের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই গাছপালা ভেঙে পড়েছে। গাছ
চাপায় এক নারীর মৃত্যুও হয়েছে। গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখনো বিদ্যুৎ
বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে আমরা। শুধু আমার ইউনিয়ন নয় আশপাশের প্রায় সব এলাকাতেই
কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাটের
মোড়েলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ভাইজোড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় প্রতিটা বাড়িতে
প্রায় তিন থেকে চার ফিট পানি জমে আছে। পার্শ্ববর্তী পানগুছি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে
এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা
বিউটি বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময়ও আমাদের এলাকায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
এবারও ঘূর্ণিঝড় হয়ে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। কদিন আগে ধান কেটে ঘরে রেখেছিলাম। সোমবার
রাতে হঠাৎ পানগুছি নদীর পানি এসে আমাদের এলাকা ডুবে যায়। আমার ঘরের ভেতরেও কোমর সমান
পানি উঠে গিয়েছিল। ঘরে রাখা চার-পাঁচ বস্তা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। চুলার ভেতরে পানি
উঠে গেছে। এলাকা থেকে পানি নামার সুব্যবস্থা না থাকায় এখনো উঠানে হাঁটু সমান পানি।
কি খাব কে আমাদের সাহায্য করবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বাগেরহাট সদর
উপজেলার কুলিয়াধাইড় গ্রামের এস এম জাহাঙ্গির কবির জানান, হঠাৎ করেই বলেশ্বর নদীর পানি
বেড়ে ঘরের ভিতর কোমর পানি হয়ে যায়। সব কিছু ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ঘরের ভিতর যা কিছু
ছিল সব শেষ। এখন চলাই কষ্টকর হবে।
বাগেরহাট পানি
উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, ঘূর্ণিঝড়
রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের বেশ কিছু বাধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত
জেলার মোট ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ
মেরামতের কাজ চলছে। অন্য ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
বাগেরহাটের
জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন বলেন, এই ঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়েছিলেন।
ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৫ হাজার ঘর বাড়ি। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা দেওয়ার জন্য উপজেলা
প্রশাসনকে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৯ লক্ষ টাকা ১১ হাজার কেজি চিড়া, ৭শ কেজি গুড় ও
২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট দিয়েছি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়টি
উপকূল অতিক্রম করার ২দিন পরও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বাগেরহাট উপকূলের ঘূর্ণিঝড়
বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ২ লক্ষ গ্রাহক।
বাগেরহাট পল্লী
বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত কুমার মজুমদার বুধবার দুপুরে বলেন, পল্লী
বিদ্যুৎ সমিতির ভৌগোলিক এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল এর ফলে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত
আমরা পুরো এলাকা পরিদর্শন করতে পারিনি। তবে যেসব এলাকা আমরা পরিদর্শন করেছি সেসব এলাকায়
মোট ১৫১ টি পোল ভেঙে গেছে, হেলে পড়েছে ২১৭২ টি পোল, ১৫৮৩ টি তার ছিঁড়ে গেছে, ট্রান্সফরমার
নষ্ট হয়েছে ৩৭ টি, মিটার ভেঙেছে ৫২৭ টি, ক্রস আর্ম ভেঙেছে ৭৩ টি, সার্ভিস ড্রপ তার
ছিঁড়েছে ৪৭২ টি এবং ইন্সুলেটর ভেঙেছে ১১৩ টি।
সকল লাইনম্যান,
ঠিকাদারের লোকবল এবং স্থানীয় লেবার একযোগে লাইন পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে।
ঝড়ে লাইনে পতিত শত শত গাছ কেটে অপসারণ করার পাশাপাশি ছেড়া তার মেরামত করে অনেক স্থানে
সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে এখনো প্রায় ২ লক্ষ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
তিনি বলেন,
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে এবং
মাঠ পর্যায় থেকে এই বিষয়ে আরো তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি লাইন রক্ষণাবেক্ষণ
কাজ অব্যাহত রয়েছে। সম্পূর্ণ লাইন মেরামত করতে আরো ২-৩ দিন সময় লাগতে পারে।
এদিকে জলোচ্ছ্বাসের
প্রভাবে বাগেরহাটের প্রায় ৪০ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় একশ কোটি টাকার
ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রামপাল উপজেলার মাছ চাষীরা।
রামপাল উপজেলার
সুন্দরপুর গ্রামের চিংড়ি চাষী শেখ আব্দুল্লাহ বলেন, প্রতিবার ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আমাদের মাছের ঘের গুলো
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে অতিরিক্ত জোয়ারের পানির
চাপে আমার ঘেরের বাঁধ ভেঙে যায় এতে প্রায় প্রায় এক লক্ষ টাকার চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে।
এছাড়া আশপাশের অনেকের ঘের তলিয়ে গেছে।
একই এলাকার
চিয়ড়ি চাষী হোসনেয়ারা বেগম বলেন, ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিনি মাছের ঘেরে
করেছিলেন। মাছ ধরার মাত্র এক সপ্তাহ আগে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।
বাগেরহাট জেলা
মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমলের প্রভাবে বাগেরহাটের প্রায়
৪০ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে চাষীদের প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এখনো বিভিন্ন স্থানে ঘেরগুলো পানিতে প্লাবিত রয়েছে, যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো
বৃদ্ধি পেতে পারে। পুনরায় মাছ চাষের জন্য আমরা চাষীদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিচ্ছি।
বঙ্গোপসাগরে
সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড়গুলোর হাত থেকে স্থলভাগকে রক্ষা করতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবন।
প্রতিবারের মতো এবারও ঢাল হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী এ ম্যানগ্রোভ বনটি। ঘূর্ণিঝড়
রেমালের প্রভাবে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে বন বিভাগ। ঘূর্ণিঝড়ের
পরদিন সকাল থেকে বনের অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ শুরু করে বন কর্মীরা।
একদিনে বনের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৩৯ টি মৃত হরিণ, একটি বন্য শুকর এবং অর্ধশতাধিক
আহত হরি হরিণ উদ্ধার করেছে তারা। এছাড়া বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস, নৌযান ও গাছগাছালির
ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগের খুলনার বনসংরক্ষক মিহির কুমার দো।
তিনি বলেন,
সুন্দরবনে এ পর্যন্ত ৩৯ টি হরিণ ও একটি বন্য শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আর ১৭টি
হরিণ জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের টহল অফিসগুলোতে টিনের চালা, জানালা-দরজা,
সোলার প্যানেল, ওয়ারলেস সিস্টেম ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব বন বিভাগের কটকা অভয়ারণ্যের
অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগিসহ
বিভিন্ন বন অফিসসহ ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
সুন্দরবনের ৮০টি মিঠাপানির উৎস পুকুরে ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে
যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে।