রেদওয়ানুল হক মিলন, পঞ্চগড় থেকে ফিরে:
পঞ্চগড়ে বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের
করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে নৌকাডুবির ৭২ জনের প্রাণহানির পর নির্মাণ হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন নান্দনিক ডিজাইনের ওয়াই আকৃতির সেতু।
এ সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বোদা উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।
সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে বিরাজ করছে আনন্দের আমেজ। নির্মাণ কাজ
শেষ হলেই এ সেতুর উপর দিয়ে চলাচল করতে পারবে দুই ইউনিয়নের মানুষ।
জানা গেছে, বোদা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের
মধ্যে দুইটি ইউনিয়ন করতোয়ার অপরপ্রান্তে। একটি বড়শশী, অপরটি কালিয়াগঞ্জ। এ দুটি ইউনিয়নের
বিপুল সংখ্যক মানুষের উপজেলা শহরে যেতে নদী পারাপার হতে নৌকাই ভরসা। যাতায়াত নির্বিঘ্নে
করতে দীর্ঘদিন ধরেই এ উপজেলার মানুষরা দাবি করে আসছেন করতোয়া নদীর এই ঘাটে সেতু নির্মাণের।
গত ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
উৎসব দূর্গাপূজার আগে মহালয়ায় অংশ নিতে বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরে
যেতে মাড়েয়া ঘাটে একটি সেলো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় উঠেছিলেন ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী।
এতে করে নৌকাটি মাঝপথে গিয়ে ডুবে গেলে প্রাণহানি ঘটে নারী-শিশুসহ ৭২ জনের। নৌকাডুবির
এ ঘটনার পর মাড়েয়া ঘাটে পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক রেলপথমন্ত্রী এডভোকেট
মো.নুরুল ইসলাম সুজন (এমপি) সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন।
সেই প্রতিশ্রুতির দুই বছরের মাথায় মাড়েয়া
বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়াঘাটে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছর ১৮ অক্টোবর ৮৯১ মিটার পিসি
গার্ডার ওয়াই আকৃতির সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন সাবেক রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম
সুজন। এর মধ্য দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর থেকে নদীর ওপর দৃশ্যমান হয় সেতু নির্মাণ। সেতু নির্মাণে
ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে সেতুর ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে
বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)। সেতুটির শুরুর অংশ
মাড়েয়ার দিকে থাকবে এবং অপর দুই অংশের একটি বড়শশী ও অপরটি কালিয়াগঞ্জের দিকে থাকবে।
স্থানীয়রা বলছেন, সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ
হলে ভাগ্য খুলে যাবে। দুটি ইউনিয়নের মানুষদের শহরে যেতে নদী পার হতে ভরসা করতে হয় নৌকার।
এতে করে ঘাটে নৌকা পার হতে যেমন বিরম্বনায় পড়তে হয় তেমনি দীর্ঘকাল ধরে ভোগান্তি নিয়ে
বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া দুটি ইউনিয়নের মানুষ নদীর তিনপারের মানুষ
সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে একই সঙ্গে চলাচল করতে পারবেন। এর আগে তারা যাতায়াত ব্যবস্থা
ঠিক না থাকায় কৃষি ও চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে শিক্ষাসহ সব সেবা থেকে পিছিয়ে রয়েছেন।
এ সেতু নির্মাণের ফলে তারা কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় সহজীকরণে
তারা অনেক সুফল ভোগ করবেন। এ সেতু বাস্তবায়ন হচ্ছে আউলিয়াঘাটে নৌকা ডুবিতে প্রায় শতাধিক
মানুষের মৃত্যু দিয়ে।
এই আউলিয়া ঘাটেই নৌকা ডুবিতে দুই স্বজন
হারানো চন্দ্র্রমোহন বর্মন বলেন, সেদিন মহালয়ায় যাওয়ার সময় নৌকা ডুবিতে ৭২ জনের মৃত্যু
হয়েছিল। আমার ভাতিজা ও তার স্ত্রী তিন সন্তান রেখে নৌকা ডুবিতে মারা গেছে। তা ভুলতে
পারছি না। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এই মাড়েয়া ঘাটে করতোয়া নদীতে ব্রীজ নির্মাণের জন্য দাবি
জানিয়ে আসছিলাম। অবশেষে নৌকা ডুবির ঘটনার পর সেতুটি নির্মান হচ্ছে।
সেতু নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এনডিই লিমিটেডের
প্রজেক্ট ম্যানেজার মো.ওয়াসিম জানান, সেতু নির্মাণের কাজ হাই লেভেলে চলছে। ইতিমধ্যে
আমাদের ৩০ শতাংশের বেশি কাজ এগিয়েছে।
পঞ্চগড় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ
জামান সাংবাদিকদের বলেন, সেতুটি দ্রুত নির্মাণে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘ওয়াই’ আকৃতির সেতু
নির্মাণের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। সেতুর মাঝ পথ থেকে দুই অংশে বিভক্ত হয়েছে। এক অংশ ৫৪৫
মিটার, আরেক অংশ হবে ৩৪৫ মিটার দৈর্ঘ্য। আশা করছি আগামী দুবছরের মধ্যেই কাজ সমাপ্ত
হবে।
এদিকে আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় নৌ
অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় ঘাট ইজারাদার আবদুল জব্বার (৫৮) ও নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়াকে
(৫২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে আছেন। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি
নৌ অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্পেশাল
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) আদালত-২ও ভারপ্রাপ্ত নৌ আদালতে
আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।